মলয় রায় চৌধুরী
তারিখটা আজও মনে আছে : পয়লা সেপ্টেম্বর ।
মেট্রো রেল স্টেশানের চত্বরে দাঁড়িয়ে, মোবাইলটা পকেটে আছে কিনা চেক করছি, একজন তরুণী খপ করে বাঁ হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ । খপ, এই শব্দটাই মাথায় এলো , অব্যর্থ শব্দ । ডেস্কটপের কি-বোর্ড পর্যন্ত শব্দটাকে নতুন মানে দিয়ে ফেলছে , স্পষ্ট অনুভব করছি । মুখে বললে অশ্লীল শোনাবে এই খপ শব্দটা ; কিন্তু হাত ধরার প্রক্রিয়ায় তো ওই আধ্যাত্মিক ইন্দ্রজাল লুকিয়ে ছিল । ইঁটের তলাকার ঘাসের মতন, রহস্যময় ।
‘চলুন পালাই’ কথাটার জন্যে নয় , বা, ডান হাতের কব্জিতে শক্ত মুঠোয় ধরার, ধরে থাকার কারণে , আমার মুখমন্ডলে যে ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ভয়, ভীতি, অতিপরিচিত ভীতি, রক্তশূন্যতা, অথচ অজানা আশঙ্কা, বিপদের পূর্বাভাস না অন্য কিছু , তা স্মৃতিতে আর ফিরিয়ে আনতে পারছি না যদিও । ব্রহ্মাণ্ড নিশ্চই ভয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল । শব্দহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, বাতাসের স্পর্শহীন, স্বাদবস্তুহীন পূঞ্জীভূত ভয় , সীমাহীন অন্ধকারে শূন্যবিন্দুতে ঘন হয়ে ওঠার ভয় । স্টেশানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলুম সেই শূন্যবিন্দুতে । হঠাৎ । আচমকা, এক নিঃশব্দ হিমশীতল বিস্ফোরণ । পয়লা সেপ্টেম্বর ।
তরুণী ফোটোক্রোমেটিক চশমায় , কাচের নিচের দিকটা ফিকে বলে গভীর চোখ দুটোয় প্রশ্নময়তার ঝিলিক । মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল । আমার চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চ ছোট ; দামি ব্র্যান্ডেড ফেডেড জিনসের ওপর সিল্কের ঢিলেঢালা টপ । আমার চেয়ে এক পোঁচ কম ফর্সা , কানে ছোট-ছোট হীরের তারা, ডান হাতে পুরুষালি ঘড়ি, বিদেশি দামি ঘড়ি — ওই হাতেই লুকিয়ে ছিল খপ শব্দটা । পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক ছাপিয়ে শ্লেষের মৃদু হাসি, বলল, কী হল ? লেট আস রান অ্যাওয়ে, চলুন পালাই ।
বিন্যস্ত, মনস্হিতিকে শান্ত করতে , স্বাভাবিকভাবে, সময় লাগছিল । আমার প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল স্মার্ট তরুণী । স্পষ্ট করে বলল, দেখুন, কত কাওয়ার্ড আপনি । নিজের কাওয়ার্ডাইসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না বুঝি ? প্রতিদিন তো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন আমায় । সারাদিনে বেশ কয়েকবার কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেন , বুঝতে পারি কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন ; এখন কী হল !
সম্বিত ফিরে পেতে যতক্ষণ । আমাদের ডিপার্টমেন্টের মায়া পাল । কয়েক মাস হল এই বিভাগে জয়েন করেছে । অফিসে তো ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলে না , কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি । ওদের সেকশানে গেলে ফিরে-ফিরে চোখ চলে যেত তরুণীটির দিকে । চার্মিং । সুন্দরী না হয়েও আকর্ষণীয়া । হাঁটার, কথা কইবার ঢঙে গর্ব ছলকায় , সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় ভালো ফলাফল করার, অঢেল মাইনে পাবার, গোমর , তখন ভাবতুম । মানুষের ভেতরের আলোর খবর সেসময়ে আমার জানা ছিল না । শুনেছিলুম, নানা চাকরি বদল করার অভ্যাস আছে তরুণীটির , একটি থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে বর্তমানে বছরখানেক আমাদের অফিসে । প্রতিষ্ঠান হিসাবে অফিস জিনিসটার আর গুরুত্ব নেই । চাকুরিজীবি নিজেই নিজের ব্র্যান্ড । তা সে যে সংস্হায় কাজ করছে সেটি যতই বিখ্যাত হোক ।
আমি জীবনে ওই একটি চাকরিই করেছি , এ ছাড়া কী করব জানি না বলে চাকরি করা শুরু করেছিলুম । বাপ-ঠাকুর্দা যা ছেড়ে গেছে তা যথেষ্ট । বিয়ে-করা, সংসার পাতা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কমিটমেন্ট ভীতি ছিল । আমি জানতুম যে আমি পলিগ্যামাস । একজন নারীর বাঁধনে নিজেকে আটকে ফেলার আশঙ্কায় প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা চিরকাল এড়িয়ে গেছি । আকর্ষিত হয়েছি, কিন্তু গড়াতে দিইনি বেশিদিন । কলগার্লদের তাই আমার ভালো লাগত ; কল গার্ল বলতে আমি আমাদের দেশের বেশ্যালয়ের বেশ্যাদের কথা বলছি না । আমাদের দেশের কথাটা এইজন্যে মনে এলো যে পৃথিবীতে আমাদের দেশের বেশ্যালয়গুলোর মতন ্রকম নংরা পরিবেশ বোধহয় আর কোনো দেশে নেই । শহরের সবচেয়ে উপেক্ষিত পাড়াটি তাদের জন্য বরাদ্দ ; ভারতবর্ষে ।
আমি নিজেকে বলতে শুনলুম, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, মানে আপনার কথার আড়ালে কী লুকিয়ে রেখেছেন, ডেসিফার করতে পারছি না । এমনিতেই আমার গলা শুকিয়ে জল বা কোল্ড ড্রিংক্সের চাহিদায় তখন । তার ওপর যারা আসপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে তারা যাতে কথপোকথন শুনতে না পায় তাই স্তিমিত কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল আমার বোকামি ।
কোনোই হেঁয়ালি করিনি আমি ; জাস্ট লেট আস গেট লস্ট । এবার বুঝতে পেরেছেন ? আমি বলছি, চলুন পালাই, আমাদের এই চেনাজানা ম্যাডনেসের বাইরে পালাই, এমন পরিবেশে যেখানে আধুনিক জগত অনুপস্হিত, যেখানে ভিড় একদম নেই, মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর, চেঁচামেচি নেই , আওয়াজ নেই, মানুষের গ্ল্যান্ডের দুর্গন্ধ নেই । অ্যাম আই ক্লিয়ার নাও ? আমার হাতের কব্জি ধরে রেখেই বলছিল মায়া । মনে হয়নি কখনও, ও এরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, ওকে দেখে কখনও মনে হয়নি যে ও মহানগরীর বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত ।
আজ বুঝতে পারি, মহানগরীয় বিতৃষ্ণা নয়, অন্য এক অজানার সন্ধান করেছিল মায়া পাল, যা জানতে পারা আমার ক্ষমতা ওজ্ঞানের বাইরে । আজও জানি না তা কী ।
একজন তরুণী তার সঙ্গে কোথাও উধাও হয়ে যেতে বলছে । কলকাতা শহরে, সকাল নটায়, অফিস যাত্রার দৈনিক ব্যস্ততার মাঝে এরকম একটা অ্যাবসার্ড প্রস্তাব দিয়ে বসল । ঠাট্টা-ইয়ার্কি নাকি হিউমিলিয়েট করার উদ্দেশ্যে, তা স্পষ্ট করার জন্যে বললুম, অকারণে অপমান করবেন না প্লিজ, তরুণীরাই আমার দিকে তাকান, তাকিয়ে থাকেন, কেউ-কেউ কথা বলতে চান, কিন্তু আমি কখনই কাউকে ডিমিন করি না, আমি প্রেমে পড়া ব্যাপারটাও ঠিক অনুমোদন করি না , তা ঘটে বলে তো মনে হয় না ।
হাত ধরে রেখেই মায়া বলেছিল, স্ট্রেঞ্জ, গলার টোন থেকে ধরতে পারছেন না যে আমি সিরিয়াস ? আমি বলছি, চলুন, সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাই কোথাও ; আমরা পরস্পরের সঙ্গে সেরকম পরিচিত নই, সেটা একটা প্লাস পয়েন্ট । কিছুটা তো চিনি একজন আরেকজনকে । বিকেল পর্যন্ত আমরা পরস্পরের পরিচিত হয়ে উঠব । পালাতে হলে এভাবেই পালাতে হয় , হঠাৎ । হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়ে , এক পোশাকে, পরিচিত জগত থেকে ফ্রিক-আউট করে যাওয়া , বিকামিঙ আননোন, অ্যাননিমাস, ফরগটন । প্রেমে পড়ার কথা তো আসছে না । কী ? ভাবছেন, আমার মাথা খারাপ ? মেন্টাল কেস ? তাহলে এরকম চাকরি পেতাম নাকি ? কত স্মার্ট ক্যান্ডিডেট তো ছিল , তা থেকে মাত্র আমি সেলেক্ট হয়েছিলাম , আপনি তা জানেন নিশ্চই ? এই ধরণের চাকরি আমি চাইলেই পেতে পারি । ভাববার সময় নেবেন না । আমিও ঠিক এক্ষুনি ভাবলাম , পালানো যাক । কাউকে বলি, চলুন পালাই , আপনাকেই সামনে পেলুম । ভাবতে চেষ্টা করবেন না । অত্যধিন চিন্তা মানুষকে দুশ্চরিত্র করে । ও , আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না ? চশমা খুলে মায়া বলল, নিন, চলুন পালাই, আই অ্যাম ডেড সিরিয়াস ।
আমার মুখ দিয়ে আমতা-আমতা কন্ঠস্বরে বেরিয়েছিল, আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে গণিত সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি ।
ফরগেট ইট, বলেছিল মায়া, জানি আপনি গণিত বিশেষজ্ঞ । ওসব ভুলে যান । গণিত কাজে লাগে না , ইংরেজিরও প্রয়োজন নেই , এরকম জনহীন অঞ্চলে চলে যেতে চাই । তাড়াতাড়ি করুন । আমার কাছে এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড আছে ; আপনার কাছেও আছে নিশ্চই । চলুন, যতটা পারা যায় তুলে নিই , তারপর নিরুদ্দেশের পথে ওগুলোর আর প্রয়োজন হবে না ।
মায়ার পরিবারে কে-কে আছে জানি না , কখনও জানিনি, জানতে চাইনি । আমার তো মা-বাবা মারা যাবার পর কেউ নেই , কেউই নেই । বিশাল বাঙলোবাড়িতে আমি একা । দাদুর বাবার ঘর, দাদুর ঘর, বাবার ঘর, বাবা-মা মারা যাবার পর আর খুলিনি । মায়ের চব্বিশ ঘন্টা কাজের বই সেলিমা বেওয়াকেও ছাড়িয়ে দিয়েছি , কেননা একা একজন যুবতীর সঙ্গে, সে কাজের মেয়ে হলেও, একই বাড়িতে থাকা যায় না । বস্তুত কেউ নেই বলেই চাকরি করি । নয়তো চাকরি করার দরকার ছিল না । মায়া পালকে বললুম, আমি অসৎ, জোচ্চোর, বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র, ফেরেববাজ, বেপাড়ার যাত্রী কিনা তা তো আপনি জানেন না ।
তরুণী হাসির মৃদু ঝিলিক খেলালেন, ঠোঁট সামান্য খুলে, বললেন, অ্যাডাম আর ইভের গল্প জানেন ? তাদের নাভি ছিল না । আমাদেরও অতীত ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আর নেই । আমরা এক্ষুনি স্বর্গোদ্যানে নেমেছি । আপনি অ্যাডাম, আপনি নিষ্পাপ । আমরা তাদের মতনই শাকাহারী । এসব কথা বলার জন্যে তো সারাজীবন পড়ে রইলো । এখন চলুন, যেদিকে পথ নিয়ে যায়, সেইদিকে ।
জানি না কে কাকে সন্মোহিত করেছিল । আমরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা তুলে, দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছে, প্রথম ফ্লাইটের খোঁজ করে, চেন্নাইয়ের বিমানে দুটো সিট পেলুম । টিকিট মায়াই কেটেছিল, মিসেস মায়া পাল আর নিরঞ্জন পালের নামে । বিমানে বসে, মায়া চুপচাপ, হয়তো নিজের ফেলে আসা অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার চেষ্টায় একাগ্র । মেয়েদের অতীত পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হয় বলে আমার অনুমান । আমি অপেক্ষা করছিলুম ওর কথার, কথা বলার, কেননা নুরুদ্দেশে যাবার আকস্মিক পরিকল্পনাটা ওরই , আমি তো তাতে সঙ্গদান করছি মাত্র । আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না
বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ ।
মায়া বলেছিল, ঠিক বলেছেন, এবার থেকে করব না ; এই রকম শব্দও তো অতীতকে ধরে রাখার ষড়যন্ত্র ।
মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।
কুকুরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমার । টাকা ফুরোলে তো ফিরতেই হবে আরামের শহুরে জীবনে । না ফেরা পর্যন্ত নিরঞ্জন পাল হয়েই থাকা যাক । মায়া হয়তো সংসারের বেড়ি-শেকল থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি চাইছে । চেন্নাইতে নেমে, আমার প্রস্তাবমত, দুটো সস্তা ক্যারিব্যাগ, মোটা চাদর, ফোলাবার দুটো বালিশ, মশারি, দক্ষিণ ভারতীয় সস্তা শাড়ি, স্হানীয়দের মতৌ শাদা আর চাককাটা লুঙ্গি কিনে, স্টেশানের কাছে হোটেলে উঠলুম । মিসেস মায়া বণিক আর নিরঞ্জন বণিক নামে । মায়া কারণ বলেনি এই নতুন পদবির । আমি অনুমান করলুম, পেছনের যাবতীয় ছাপ মুছে ফেলতে চাইছে, প্রতিটি পদক্ষেপের, যাতে কেউ খুঁজে না পায় আমাদের । দক্ষিণ ভারতীয় সাপড়া, মানে ভাত সাম্বর রসম পাঁপড় পাতলা দই খেয়ে মায়া দিব্বি ঘুমোলো সারারাত । কোনো তরুণির পাশে শুয়ে ঘুমোনো , আমার মতন জার্মান শেপার্ড বা কুন হাউন্ডের পক্ষে অসম্ভব ছিল । জেগে রইলুম সারারাত । লক্ষ করলুম, মায়ার কানের হীরের টপ, আর হাতের মোটা চুড়িটা নেই । মায়ার পারফিউমের মায়াবিনী সুগন্ধের স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে শুয়ে-শুয়ে সেদিন ভেবেছিলুম, এ কিরকম সম্পর্ক ! এ তো প্রেম নয়, কয়েক ঘন্টার জন্যে কেনা মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়া নয় ল সম্পূর্ণ অচেনা একজন মহিলার পাশে শুয়ে আছি , কেন তার কারণ নিজেই জানি না । মগজে ঘুরঘুর করছে ভাবনার ধোঁয়া ।
কে এই মহিলা ? কী চায় ? ধর্মের ঘেরাটোপে পাগল রমণী ?
পাল যখন তখন বৈষ্ণব নয় বলেই তো মনে হচ্ছে যে গোপন বৈরাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ? ফেডেড জিন্স পরে !
একজন প্রায় অচেনা পুরুষের পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে কী করে ঘুমোতে পারে একজন যুবতী , যে দেখতেও ভাল, এমনকি আকর্ষক ?
জীবন থেকে কিছু চাই ? চাইলে আমার তো তাতে কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয় ?
হয়তো আমার ভূমিকা ছকে রাখা আছে, ক্রমশ প্রকাশ্য । দেখাই যাক । একটা উদ্দেশ্য তো হল । বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য !
আমি একজন যধবতীর পাশে শুয়ে আছি , অথচ আমার শরীরে কোনো যৌন প্রতিক্রিয়া ঘটছে না । এর আগে কোনো যুবতীর সঙ্গে শোবার প্রস্তুতির পর্ব থেকেই আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আনন্দনৃত্য শুরু হয়েছে । উদ্দেশ্যহীন শুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি আগে ।
চেন্নাই স্টাশানে পোঁছে, প্রথম ট্রেন পাওয়া গেল নেল্লোরের, তার দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে উঠলুম । হোটেল মালিকও বলেছিল, হনিমুনের জন্য নেল্লোর হয়ে কডপ্পা জেলার ম্যাগনামপেট অঞ্চলে ব্যারাইট ব্যবারিটাস খনি-অঞ্চল ছাড়িয়ে কিছুটা দক্ষিণপূর্বে গেলে খুবই ভাল সময় কাটবে ; সেখান থেকে আরও দক্ষিণে ভেতরদিকে গেলে , কর্ণটক সীমান্তের কাছাকাছি, একেবারে আধুনিকতা-বর্জিত গ্রামসমাজে যাওয়া যায় , উপজাতিরা থাকে, এমন জনসমাজ যেখানে অভাব আছে কিন্তু সেখানের লোকেরা তাকেই জীবন মনে করে , দারিদ্র্যই তাদের বেঁধে রেখেছে পরস্পরের সঙ্গে । তবে যেতে-আসতে অনেক হ্যাপা ।
আমার দশ কিলোমিটার মর্নিংওয়াকের অভ্যাস আছে । মায়াকে জিগ্যেস করেছিলুম, যাবেন কি ওই অঞ্চলে ?
মায়া বলেছিল, ওরকম অঞ্চলই তো চাইছি । দেখছেন তো ক্রমশ আমরা ইশারায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি , কেননা সকলে আমার-আপনার ভাষা কাজ চালাবার মতন জানে । আমরাও এনাদের ভাষা একবর্ণ বুঝি না, তবুও বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ তো চলে যাচ্ছে , কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না ।
মায়া পালের কথা শুনছিলুম । যত শুনছিলুম, তত ওকে স্ট্রেঞ্জ মনে হচ্ছিল । ও তো, বুঝতে পারলুম, ব্যারাইট জিনিসটার নামই শোনেনি । বললুম, ব্যারাইট অনেকটা আপনার মতন, ঝিকমিক-ঝিকমিক ক্রিস্টাল দিয়ে গঠিত খনিজ, অনেক রকমের কাজে লাগে । শুনে, আমার মনে হল, ভালো লাগল মায়ার । ওর পাতলা ঠোঁটে হাসি খেলল । ওর বিভিন্ন মৃদু হাসিগুলোর মানে আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি । নারীর স্টকে কত রকমের হাসি থাকে তার ইয়ত্তা নেই ।
নেল্লোরে নেমে ট্রেন পালটিয়ে কোদরু । নেল্লোরে যাবার পথে আমার মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড নিয়ে নিজের পার্সে ঢুকিয়ে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মায়া । শখের কালো চশমাটা দিয়ে দিল আমাদের সামনে বসে-থাকা ছেলেটিকে, যে মায়ার পার্স ছুঁড়ে ফেলা দেখে তখনও পর্যন্ত সম্বিত ফিরে পায়নি । নিজের কার্ডগুলোও এক-এক করে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আম কলা পাতিলেবু পেঁপের চাষের এলাকা আর ব্যারিটাইসের খনি অঞ্চল শুনে এই এলাকা চিহ্ণিত করেছিল মায়া । কোদরু থেকে ভাড়ার জিপগাড়িতে আধকাঁচা রাস্তার ধুলোর কুয়াশা ওড়াতে-ওড়াতে খনি অঞ্চল । প্যাংলা শ্রমিকদের আনাগোনা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছিল যে খনি অঞ্চল এসে পড়ল । খনি ম্যানেজারকে আমাদের উদ্ভট হনিমুন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে, মিস্টার কৃষ্ণাইয়া ওনাদের রেস্ট হাউসে রাতটা কাটাতে দিলেন । এখানেও দুজনে পাশাপাশি শুলুম । তবে বিছানাটা বিশাল বলে আর ঘরে এসি থাকায় অসুবিধা হল না । রাজ্যের কেষ্টবিষ্টুরা এসে থাকেন বোধহয় , তাই বেশ সাজানো-গোছানো ।
আমি অতিপ্রয়োজনীয় ঘুমটা দিয়ে নিলুম । সকালে রেস্ট হাউসের দেয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে অজানা সাংসারিক জীবনের পথে রওনা দিলুম । ব্রেকফাস্টে যাতে ডিম আর দুধ দেয়া না হয় তা ওখানের খানসামাকে বলে দিয়েছিল মায়া । চা কেবল লিকার । ভাবলুম, বোধহয় শনি-মঙ্গলবার ধরণের কোনো স্ত্রী আচার । আমি তো নিজেই যা হোক ব্রেকফাস্ট খাই , ওটস, পরিজ, ব্রেড-স্যান্ড উইচ বা অফিসে পৌঁছে অর্ডার করি । এই অঞ্চলে রেস্টহাউসেই আমরা শাওয়ার বাথ করেছিলুম, একসঙ্গে নয়, প্রথমা মায়া তারপর আমি । যদিও আমার আশঙ্কা ছিল হয়তো মায়া সেরকম কোনো প্রস্তাব দিয়ে বসবে । রহস্যময়ী, অতএব কখন কোন রহস্যের ঘুর্ণিতে গিয়ে পড়ি , তার জন্যে নিজেকে সবকিছুর মুখোমুখি হবার জন্যে প্রস্তুত করে নিয়েছিলুম । মায়ার কার্যকলাপ দেখতে-দেখতে আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে ফেলছিলুম ।
খনি ম্যানেজার একজন শ্রমিককে দিলেন গাইড হিসাবে । প্রথমে খনির ম্যাটাডর গাড়িতে, ড্রাইভারের পাশে গাইড, আমরা ক্যারিয়ারে হেলান দিয়ে । গাইড প্রস্তাব দিয়েছিল যে আমরা দুজনে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসি । মায়াই ক্যারিয়ারে বসার আইডিয়া দিয়েছিল, চারিদিকের দৃশ্য দেখতে-দেখতে যাবে বলে । সূর্যের অবস্হান দেখে বুঝতে পারছিলুম যে আমরা দক্ষিণের দিকে কোথাও যাচ্ছি ।
ম্যাটাডর আমাদের যে জায়গায় নামাল, গাঈদের পরামর্শে সেখানকার রাস্তার ধারের এক নোংরা ঢাবায় বিরাট-বিরাট জংলি পাতায় মোটা চালের ভাত আর ভিষণ ঝাল সাম্বর খেলুম । মায়াকে বলেছিলুম, যে কোনো জায়গায় জল খাবার অভ্যাস আছে তো , নয়তো পেট খারাপ হতে পারে । জবাবে মায়া বলেছিল, হলে হবে, ইমিউন হতে হবে তো, নয়তো থাকব কী করে সারাজীবন !
ঘাইড কোথা থেকে একটা গোরুর গাড়ি ডেকে এনেছিল, যতক্ষণ আমরা খাচ্ছিলুম সেই ফাঁকে । দক্ষিণ ভারতীয় বলদ । ওপর দিকে শিঙ উঠে ভেতরে বেঁকে এসেছে , গায়ে-গতরে পশ্চিমবঙ্গের বলদগুলোর চেয়ে স্বাস্হ্যবান । অদ্ভুত লাগল । লোকগুলো প্যাংলাটে আর বলদগুলো ভারিভরকম । মায়া দুহাত এগিয়ে দিয়ে বলল আমাকে গাড়িটায় তুলে দিন । দিলুম । অচেনা একধরণের ঠান্ডা ওর দেহকে ঘিরে রেখেছে মনে হল । এরকম ঠান্ডা দেহের নারী শরীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । পারফিউমের গন্ধ ছিল তখনও পর্যন্ত , নিশ্চই কোনো বিদেশি দামি পারফিউম লাগিয়েছিল বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে । গায়ে পারফিউম মেখে কেউ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে যায় ? গাড়িতে উঠে মায়া বলেছিল, যাক, বলদগুলোকে অত্যধিক খাটায় না , ওদের স্বাস্হ্য ভালো ।
গাড়ির ওপর শুকনো পেঁপেপাতার গদিতে বসলুম আমরা , আর হেলতে-দুলতে চললুম, মায়ার অদেখা স্বপ্নভূমিতে । এখানকার সূর্য কলকাতার সেপ্টেম্বরের সূর্য নয় । মায়ার মুখে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠছিল । মনে পড়ছিল না যে এত কাছ থেকে কোনো যুবতীকে এভাবে ঘামতে দেখেছি কিনা । আম কাঁঠাল লেবু পেঁপে আতা সজনেডাঁটা ইত্যাদি বাগানের পাশ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি করে অত্যন্ত ক্লান্ত দেহে ভোরবেলা পৌঁছোলুম এক গ্রামে , যেখানে শ্রমিকটি আমাদের আরেকজনের জিম্মায় দিয়ে চলে গেল । তাকে খি বুঝিয়েছিল জানি না, কেননা ভাষাটা ঠিকমতন ডেসিফার করতে পারছিলুম না । সে আমাদের ক্যারিব্যাগ দুটো মাথায় চাপিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল , আমরা পেছন-পেছন । ঘন্টাখানেক হেঁটে, একটা সরু ঝর্ণার পাশ দিয়ে , যে গ্রামে পোঁছোলুম, তার নাম লোকটি আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছিল, অগ্রমগাগি, কর্ণাটকের সীমান্তের কাছাকাছি । মজুরি হিসাবে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে নিতে অস্বীকার করল । মায়ার নির্দেশমত আমরা হাত-ঘড়ি দুটো দিয়ে দিলুম , যদিও কী কাজে যা লাগাবে লোকটা কে জানে । হয়তো বেচে কিছু রোজগারপাতি হবে ।
লোকজন দেখতে পাচ্ছিলুম না । চারিদিকে গাছপালা, বনাঞ্চল বলা যায় । গ্রাম বলে তো মনে হল না । জঙ্গলে এনে ছেড়ে দিল নাকি, যখন ভাবছি, একজন চাষিমতন লোক একটা বছর তেরো-চোদ্দর ছেলেকে গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে-পেটাতে এদিকেই আসছিল । দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল মায়া , আর লোকটাকে বাংলাতেই যেভাবে বকুনি দেয়া শুরু করল তা বুঝতে কোনো ভাষাভাষিরই অসুবিধার কথা নয় । লোকটা তেলেগু ধরণের ভাষায় ছেলেটির অপরাধ, মনে হয়, ব্যাখ্যা করল, আর একেবারে অপরিচিত শহুরে দম্পতি দেখে অবাক প্রশ্ন তুলল ; অন্তত সেরকমটাই মনে হল । আমি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমরা এখানে থাকতে এসেছি । নিজামদের প্রভাব কিনা কে জানে, লোকটা বিস্মিত কন্ঠে যা বলল, হায়দ্রাবাদি হিন্দি মেশানো তেলেগুতে, যা পরে জেনেছি আঞ্চলিক ভাষা তুরপু, তা হল যে এই অঞ্চল আপনাদের মতো মানুষের বসবাসের অযোগ্য , এটা ঠিক গ্রাম নয়, এটা আউটার এরিয়া, আমরা অনেক দূরে-দূরে থাকি , কেউই এক জায়গায় থাকি না । এই জঙ্গলটা গড়ে ওঠার আগে আমরা এই জঙ্গলের জমিতেই থাকতুম , আম লেবু পেঁপে কলার খেতে কাজ করতে যেতুম , এখনও প্রায় সকলেই ফলের বাগানে কাজ করতে যায় , তার জন্যে দুবেলা অনেকটা হাঁটতে হয় । এখানে আলো নেই , জল ভরতে অনেকটা হাঁটতে হয় , স্কুল নেই, পঞ্চায়েত দপতর এতো দূরে যে নেই বললেই চলে , কোনো সরকারি লোক আসে না এখানে , লোকে দুবেলা খেতে পায় না , পায়খানা নেই, মাঠে যেতে হয়…
লোকটি বলতে প্রচুর সময় নিয়েছিল , প্রায় আধ ঘন্টা, আমি তার কথার একটা নির্যাস লিখলুম । যাহোক, মায়া তাকে থামিয়ে সর্বভারতীয় খিচুড়ি ভাষায় বলল যে আমরা এখানেই থাকব , তোমাদের সঙ্গে, তোমাদের মতনকরে থাকব ।
মায়ার কথাগুলো আমি আরেকটু বোধগম্য হিন্দি করে বললুম লোকটাকে । সঙ্গের ছেলেটি একবার আমাদের আর একবার ওর বাবার মুখ দেখছিল । আঁচ করলুম যে ছেলেটি বোধহয় তার বাবার চেয়ে ভালো হিন্দি বলতে পারত, যেভাবে সে মৃদু হাসছিল আর কিছুটা অবাক হচ্ছিল আমাদের কথোপকথন শুনে । আমরা ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলুম ।
লোকটা বলতে-বলতে যাচ্ছিল, আমি আগে ব্যারাইট খনিতে কাজ করতুম, কিন্তু আমার স্ত্রীর ওই কাজ পছন্দ হচ্ছিল না বলে চলে এলুম, কেননা ওখানকার জল নষ্ট হয়ে গেছে খনির কারণে , শ্রমিকদের নানারকম রোগ হচ্ছে , আমার ছেলেটাও ওখানে কুসঙ্গে পড়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, শহরের ছেলেরা আজকাল যেমন হয় ; এখানে ফলমূল খেয়ে চলে যায় । পরে জেনেছি এখানকার তুরপুরা উপজাতি, তাই কারোর নজরে পড়ে না ; এরা ভোটাভুটি সম্পর্কেও আগ্রহী নয় । আরও পরে জেনেছিলুম যে এই অঞ্চলে মাটির তলায় আছে লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ ।
আমরা লোকটির পেছন-পেছন তালপাতা পেঁপেপাতা আর গাছের ডালপালা ছাওয়া দরজাহীন একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলে, আমাদের পথপ্রদর্শক তিন-চার বার হাঁক পেড়ে ডাকল কাউকে । কিছুক্ষণ পর যে লোকটি উদয় হল , তাকে দুর্বোধ্য বুলিতে বোঝাল আমাদের বক্তব্য । সেই লোকটা আরও রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কতকাল স্নান করেনি কে জানে । তার কথা আমাদের দোভাষী, বাধ্য হয়ে দোভাষী বলতে হচ্ছে আমাদের পথপ্রদর্শককে, অনুবাদ করে বলল যে একটা ঝুপড়ি আছে , যার ছিল সে বহুকাল আগে হায়দ্রাবাদ কিংবা ব্যাগালুরু চলে গেছে বোউ-বাচ্চা নিয়ে, আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি ল
শুনে, মায়ার মুখ আলোকিত হল । আমার বিমূঢ় মুখ দেখে মায়া বলেছিল, আমি তো আছি, আশঙ্কা কিসের ।
উত্তরে বলেছিলুম, আমার এতক্ষণ ভুল ধারণা ছিল যে আমি আছি বলে আপনার কোনো আশঙ্কা নেই । প্রতিক্রিয়ায় মায়া মৃদু হাসি খেলিয়েছিল ঠোঁটে । চোখ বুজলেই আমি মায়ার এই বিশেষ হাসি-মাখানো মুখ দেখতে পাই । কতদিন কতবার যে দেখেছি ওর এই অনুমোদনমূলক হাসি , আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে ছবিটা ।
আশ্চর্য ! জায়গাটায়, চালাঘরটায় থেকে গেলুম আমরা ! ক্রমশ রপ্ত হতে থাকল মূল ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা । কাঁচকলা পোড়া, কাঁঠালবিচি সিদ্ধ-চটকানো , আর কখনো=সখনো আম বা পাকা পেঁপে খেয়ে, কেবল দিনের বেলায় , কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন । অবশ্য যে ছেলেটিকে মায়া মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল , সে আমাদের ভারতীয় জীবনে সেটল হতে সাহায্য করেছিল । সে তালপাতার একটা চাটাই দিয়ে গেছে, যদিও তা অতিব্যবহারে চলনসই গোছের । সে আর তার বয়সী কয়েকটি ছেলে লেগেই থাকত আমাদের সঙ্গে । আমাদের সম্পর্কে তাদের কৌতূহল ; এত কাছ থেকে শহরের মানুষদের জীবনযাত্রা দেখেনি তারা । বহুবার প্রশ্ন করে তার নাম জেনেছে মায়া, সম্পূর্ণ নাম আমাদের পক্ষে উচ্চারখ করা কঠিন বলে মায়া ওকে বালু নাম দিয়েছে । সম্ভবত বালাজীর কোনো একটা নামের স্হানীয় রূপ । বালু কালো রঙের প্লাসটিকের ঘড়া আর প্লাসটিকেরই গেলাস দিয়ে গেছে জল ভরে রাখার আর খাবার জন্যে । ঘড়াটায় পুরো জল ভরা যায় না ; ওপর দিকটা সামান্য ফাটা । গেলাস চাপা দিয়েও কোনো লাভ নেই । প্রতিদিন জল না বদলালে মশা ব্রিড করবে , মায়াকে বলতে ও বলেছিল, এর সবাই তো খাচ্ছে, মশার ডিমসুদ্ধই খাচ্ছে হয়তো , আমরাও না হয় খাবো, ক্ষতি কী ।
কিছু দূরের বিশাল গভীর কুয়ো থেকে গ্রামের মহিলারা জল ভরে আনে দেখে মায়া নিজেই ঘড়া কাঁখে নিয়ে জল ভরে আনে । যতটুকু জল ও বইতে পারে ততটুকু, আমাদের তেষ্টা তাতেই মেটে । ব্লাউজহীন শাড়ি পরা আরম্ভ করেছে স্হানীয় মহিলাদের অনুকরণে । ব্লাউজহীন মায়াকে দেখে প্রথম-প্রথম আমার অস্বস্তি হতো ; তাকাতে লজ্জা করত । মায়াই একদিন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে হয়ে , ভুলে যাচ্ছেন কেন, তাকান তাকান তাকান তাকান, তাকিয়ে থাকুন ।
আমিও খালি গায়ে কেবল লুঙ্গি পরে থাকি । প্রথম দিন বিব্রত বোধ করেছিলুম , লুঙ্গি পরা আর খালি গায়ে থাকা, এই দুটিরই অভ্যাস ছিল না । মায়াকে দেখি আর নিজেকে কেমন দেখতে হয়েছে হয়ে যাচ্ছে অনুমান করি । গোঁফদাড়ি না কামিয়ে কেমন দেখাচ্ছে তা কালো ঘড়ার জলেতেও দেখার উপায় নেই । কোথাও প্রতিফলনের সুযোগ নেই । সত্যিই , নার্সিসিজম ঘটার কোনো সুযোগ নেই । তার মানে বহু মানুষ জীবনে মাত্র কয়েকবার আয়না দ্যাখে ; দ্যাখার প্রয়োজন বোধ করে না ।
মায়া কী করে চালাচ্ছে বিনা আয়নায় ? আজকালকার যুবতীরা নিজের প্রতিফলন দিনে বহুবার দেখেন । মায়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সেই মায়ার সঙ্গে যে অফিসে আসার আগে নিজেকে সুশ্রী করে তুলে আনতো । অফিসেও টয়লেটে গিয়ে চুলের বিন্যাস গুছিয়ে ঠোঁটে লিপ্সটিকের নবীকরণ করে নিতো । বাড়ি যাবার সময়ে আবার একবার রূপটান দিয়ে নিত ! নারীর অন্তরজগতে পরিবর্তনের দ্রুতি কি পুরুষদের থেকে ভিন্ন ? বা, হয়তো, মায়া পাল নিজেকে নিয়ে চলেছেন এমনই এক জগতে যার সঙ্গে তাঁর নিজেরই পরিচয় হয়নি ? ভাবতুম ।
এখানে রাতের বেলায় না খেলেও চলে, এই প্রথম জানলুম । অন্ধকারেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । প্রতিদিন স্নান না করেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । ঘরের দরজা বন্ধ না করেও ঘুমোনো যায়, এই প্রথম জানলুম । লুঙ্গি পরে, গায়ে জামা না পরে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । দাড়িগোঁফ না কামিয়ে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । মাঠে বসে হাগা যায়, এই প্রথম জানলুম । অচেনা গাছের ডালে দাঁত ব্রাশ করা যায়, এই প্রথম জানলুম ।
মায়া কোথায় প্রাতঃকৃত্য সারতে যায় তা জানি না ; হয়তো অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ।
একজন নাপিত আসে মাসে কখনও গ্রামে যারা চায় তাদের দাড়ি কামিয়ে গোঁফ ছেঁটে দিয়ে যায় । আমি আমার গোঁফদাড়িকে স্বাধীনতা দিয়েছি, যেভাবে ইচ্ছা বেড়ে উঠুক ।
তবে, মশারি টাঙানো থেকে মুক্ত হতে পারিনি । সন্ধা্যা হলেই মশারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকি, মশা আর অজানা কীটের ভয়ে । মায়া বাধা দিয়েছিল । বোঝাতে চেয়েছিল ওকে যে ম্যালেরিয়া হলে যে উদ্দেশ্যে মায়া এসে্ছে তা পূরণ হবে না । অবশ্য কী যে ওর উদ্দেশ্য ছিল তা আজও জানি না ল মাটিতে চাটাই আর মোটা চাদর পেতে শুই । প্রায় সপ্তাহখানেক মেঝের উঁচুনিচু মাটির সঙ্গে খাপখাওয়াতে সময় লেগেছিল । ক্রমশ অমনভাবে শোয়ায় অভ্যাস করে ফেললুম । সহ্য হয়ে গেল ল
উটকো দুজন বাইরের মানুষ এসে তাদের সমাজে থেকে গেল, অঞ্চলের কারোর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলুম না । শহরে হলে, ক্লাবের ছেলেরা, পার্টির লোকেরা, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই অযথা নাক গলাতো । এখানে কেউ নামও জানতে চাইল না । আমরা কোন ভাষায় কথা বলি বা কোথা থেকে এসেছি , তাতে কারোর কোনো আগ্রহ নেই । ভারতবর্ষে মানুষের চরিত্র ছোটো-ছোটো দ্বীপের মতন পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ।
একদিন মায়া বলল, গারু, এখানে পুরুষদের গারু বলে ডাকে, কলকাতায় যেমন স্যার কিংবা বাবু বা দাদা, মায়া বলেছিল, গারু, আজকে আমার মেন্সটুরেশান শুরু হল, হয়তো সেকারণে মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, কিছু মনে করবেন না ।
ভালই হল, বলেছিলুম আমি, এখানে ক্যালেন্ডার বা মাস-তারিখ জানার কোনো ব্যাপার নেই ; আপনার মেন্স যেদিন হবে আমাকে অবশ্যই বলবেন, আমি সামনের কাঁঠাল গাছটায় খুরপি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখব , তাহলে মারা যাবার সময়ে আমি বা আপনি জানতে পারব, কতদিন একসঙ্গে ছিলুম । শারীরিক কষ্টের মধ্যেও জোরে হেসে উঠেছিল মায়া । হাসছিল ও, অথচ তার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল আমার অস্তিত্বে , রিন রিন রিন রিন রিন । কারোর হাসি যে গা-ময় লেগে থাকে, তার কথা যে মগজের ভেতরে বাজতে থাকে, তার দেহের গন্ধ মনের মধ্যে ফিকে ঢেউ তোলে, তা মায়ার সংস্পর্শে না এলে জানতে পারতুম না ।
কলকাতায় নিজেকে কখনও পরগাছা মনে হয়নি । এখানে, তিন দিনেই মনে হতে লাগল যে পুরুতদের মতন বা পার্টিকর্মীদের মতন অন্যের দানে পেট ভরাতে হচ্ছে । বেশ গ্লানিময় । এত পড়াশোনা করেছি, গণিতে প্রথম শ্রেণি থেকে প্রথম হয়েছি চিরকাল, এই প্রায়-জনহীন গ্রামে সেসব জ্ঞানের কিয়দংশও কাজে লাগছে না । মায়াকে বলতে, ও বলল, ওর অবস্হা আরও খারাপ, ও চিরকাল ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছে ।
ঘুরে-ঘুরে দেখেছি, আম লেবু পেঁপের গাছে তেলেগুতে সংখ্যা লেখা । গণিত আর ইংরেজি দুটোই সেক্ষেত্রে ফালতু বলেই মনে হল এই অঞ্চলে । তার চেয়ে, দুজনেই ঠিক করলুম, আমরাই শিখি । এই অঞ্চলের কীট পতঙ্গ আগাছা আচার ভাষা যা জানি না, তা-ই শেখার প্রয়াস করি ।
ওর বাবা ব্যারেটাইস খনিতে কাজ করার সময়ে বালো ওখানকার খনিশ্রমিকদের স্কুলে একবছর পড়েছে । বালুকে প্রস্তাব দেয়া হল যে সে আমাদের তেলেগু শেখাবে , যতটুকু ও জানে, অক্ষরজ্ঞান হলেই চলবে , প্রতিদানে আমি ওকে ইংরেজিতে এক দুই তিন চার শৈখাব , আর মায়া শেখাবে এ বি সি ডি । সমস্যা দেখা দিল শুরু করতে গিয়েই । ওর বা ওর পরিচিত কারোর বাড়িতে স্লেট-পেনসিল বা কাগজ কলম নেই । বালুই উপায় বাতলালো । আমাদের চালার বাইরে পেছনদিকে মাটির দেয়ালে কাঠ-কয়লা দিয়ে লেখা হবে আর ভিজে ন্যাকড়ায় তা পোঁছা হবে । ও উৎসাহিত, এইজন্যে যে ও দুটো জিনিস শিখবে আর আমরা দুজনে কেবল একটা । আমাদের ক্লাস নেয়া-দেয়া দেখাতে বালু নিজের মাকে এনেছিল । বালুর মা পরের দিন এসে কুমড়ো দিয়ে গিয়েছিল, যেটা দিয়ে কি করা হবে যাতে তা খাওয়া যায় ঠাহর করতে না পেরে মায়া শেষপর্যন্ত কুমড়ো-পোড়া বানিয়েছিল । গরম-গরম ভালই লেগেছিল খেতে , নুন-হীন । নুন খায় এ-অঞ্চলের লোকে, কিন্তু কুসংস্কারবশত নুন কেউ দিতে চায় না । আর চিনি তো খায়ই না এরা, পায়ই না তো খাবে কোথ্থেকে ! লঙ্কা হয় কারোর কারোর বাড়ির সামনের জমিটুকুতে– এনে দ্যায় বালু ; লঙ্কা দিয়েই স্বাদকে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলুম আমরা ।
বালুর দেখাদেখি দশ-বারো দিনে আরও চারজন ছাত্র জুটে গেল আমাদের । ক্রমে গ্রামের, গ্রাম বলতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরত্বের সব আগ্রহী ছেলেমেয়ে চলে আসতে লাগল । যার যখন সময় । ওদের শেখার আর আমাদের শেখার তো কোনো নির্দিষ্ট স্কুলসময় বলে রুটিন ছিল না । তাদের মধ্যে থেকে আমরা একজন শিক্ষিকা পেলুম, সিরিদেবি, বোধহয় শ্রীদেবীর অপভ্রংশ, যে তেলেগুতে আমাদের এক দুই তিন চার শেখানো শুরু করল । তারা যে মায়াকেই বেশি পছন্দ করছে তার স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠছিল ছাত্রছাট্রিদের মুখে আর ব্যবহারে । মায়া ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারে , আমার কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকে । পড়াবার সময়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমাদের পা ব্যথা করতে পারে অনুমান করে সিরিদেবির বাবা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দুটো টুল বানিয়ে দিয়ে গেছে একটা একটু নিচু,মায়ার জন্যে, আরেকটা আমার কোমরের উচ্চতায় , আমার জন্যে ।
মাঝে-মথভে পড়াবার দেয়ালটা মাটি দিয়ে লেপে নতুন করে দিয়ে যায় কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর মা । নয়তো মায়া নিজেই কোথাও থেকে গোবর এনে সারাদিন লেপার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । মায়া আমাদের চালার ভেতরটাও গোবরে লেপে ফেলেছে । কোথায় যে গোবর পায় তা জানি না ; এখনও তো গোরু বা মোষ নজরে পড়েনি । হয়তো গ্রামের লোকেরা নিয়ে আসে কোথাও থেকে । যখন এক মনে দেয়ালে গোবর লেপে মায়া, আমি ওকে দেখেছি আর অবাক হয়েছি । নিজেকে একেবারে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে মায়া ; দেকতে থাকলে মনে হয় ঠিক যেন রঙ করার আগের মাটির প্রতিমা যার চোখদুটো কেবল আঁকা হয়েছে । আমি নেজেকে কীরকম দেখতে হয়েছে অনুমান করতে পারি ; ক্রমশ মহিষাসুর হয়ে উঠছি , সবুজদেহ অসুর নয়, কয়লাদেহ ।
মায়া চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে তেলেগু সংখ্যা আনকেলু এক দুই তিন চার অর্থাৎ ওকাতি , রেন্ডু, মুন্ডু, নালগু, আইডু, আরু, এডডু, এনিমিডি , তোম্মিদি, পাডি মুখস্হ করত । স্বরবর্ণ বা আচ্ছেলু , ব্যঞ্জনবর্ণ বা হাল্লুলু মুখস্হ করত । আমি ওর সঙ্গীতময় কন্ঠস্বর শুনতুম আর মনে রাখতুম । আজও আমার কানে ওরই তেলেগু অক্ষর বাজছে , যখন এই লেখাটার জন্যে কি-বোর্ড টিপছি । অক্ষরগুলো গোলগোল , বাংলার চেয়ে বেশ কঠিন, ইংরেজির থেকে তো বটেই । মায়া আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে । আমার একটা অক্ষর রপ্ত করতে , এবং তার পরের অক্ষরে গিয়ে প্রথম অক্ষরে ফিরে আসতে তিন-চার দিন লাগছে ।
ও, মায়া, কুয়োতলায় গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় তারাও ওকে নানা কথা বলে , আমাদের সংসার গুছিয়ে ফেলেছি কিনা তারা জানতে চায় । মহিলারা জল তোলার সময়ে বাচ্চাকে মায়ার কোলে দিয়ে দেয় । ও ফিরে আসলে ওর গা থেকে শিশুদের গন্ধ বেরোয় । মায়া ফিরে এসে সেই দিনকার কোন বাচ্চা ওকে বেশি আদর করল তার গল্প শোনায় । মনে হয় জল ভরার অছিলায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করতেই যায় ও । কোনো-কোনো যুবতী শিশু দেখলেই কোলে নিতে চায়, তার সঙ্গে তোতলা কথা বলতে চায়, মায়া সেই ধরণেরই এক যুবতী । মায়া যেন মায়াময় ।
আমি গল্প করার বিশেষ কাউকে পাই না, ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া । বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন দূরের এক-আধটা চালায় , কিন্তু কী গল্পই বা করব তাঁদের সঙ্গে । তাঁরা আমার কথা বুঝতে পারবেন না, আমি তাঁদের । অনেক সময়ে মনে হয় স্হানীয় পুরুষদের মতন আমিও কোনো ফলের বাগানে গিয়ে চাকরি নিই , অন্তত ভাঙা-ভাঙা কথা বলার লোক তো পাব । মায়াকে সেকথা জানালে ও রাজি হয় না । বলল, ওরা টাকা দেবে, তা নিয়ে কী করবেন ? নতুন সমস্যা দেখা দেবে । টাকা এলে তার সঙ্গে সংসার পাতার প্রক্রিয়াও এসে পড়বে , জীবনে চাই না, এরকম অপ্রয়োজনীয় বস্তু জড়ো হয়ে যেতে পারে , যদিও এখানকার কারোর সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি যে অমনধারা জিনিস সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছে ।
শিক্ষকতার দরুণ গুরুদক্ষিণাও জুটতে লাগল , ইন কাইন্ড, এবং একদিন চালও পাওয়া গেল , লাল খোসাসহ, ব্রাউন রাইস, যা দেখে মায়া বলেছিল, কলকাতায় কত খুঁজেছিলাম প্রকৃত ব্রাউন রাইস , আর এখানে এটা গরিব গ্রামবাসীর খাদ্য ।
বললুম, দেখছেন তো ? অতীত কী ভাবে ঘাপটি মেরে থাকে ! শুনে, মায়া যেন কেমনতর উদাসীন হয়ে উঠল । বেফাঁস কথা বলায় আমিও বেশ অপ্রস্তুত হলুম ।
চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে , কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে , লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না , কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন ।
জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন , আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি ?
স্মৃতিচারণ মায়া করেছিল, করে ফেলেছিল, কয়েকজন বিদেশী সাহিত্যিকদের জীবনবোধকে একদিন তীব্র আক্রমণ করে ; আমি তাদের বইটই তখনও পর্যন্ত পড়িনি । তাই মুখ বন্ধ রেখে মায়ার জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ উপভোগ করেছিলুম ।
ভাত পেয়ে, মায়া বলেছিল, ভাতও খাবো কিনা সে-চিন্তায় ছিলাম , কেননা ভাতের সঙ্গে তো অতীত জুড়ে রয়েছে । আপনি আমাকে ভালোবাসার চোখে দেখবেন তা আমি জানি , আমিও যে আপনাকে ভালোবাসছি, ভালবেসে ফেলেছি, তা অনুভব করছেন না ? আমার চোখের পানে সরাসরি তাকিয়ে মায়া যোগ করেছিল, বালুরা যে ঝর্ণার জলে স্নান করতে যায়, কালকে চলুন সেই ঝর্ণায় গিয়ে স্নান করি , আমাদের সত্যিই এবার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, নয়তো আচমকা কোনো রোগে দুজনের একজন আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি ।
আমি বলেছিলুম, কালকে নয়, যেদিন আপনার চতুর্থ মেন্সের দাগ কাঁঠালগাছে আঁকব, সেই স্নান ঝর্ণার জলে করবেন ।
—আপনি জানেন দেখছি , মধ্যবিত্ত সংস্কার অনুযায়ী স্নান করতে হয় ।
—হ্যাঁ, পর পর তিনবার আপনাকে স্নান করতে দেখলুম না, বলার সাহসও হয়নি ।
—আদিম মানবীরা কি স্নান করত ? বিদেশের প্রতিটি দেশের মহিলারা কি স্নান করেন ? এখানের মহিলারা করেন ? স্নান করাটা, দেখেছেন তো, এখানকার জনজীবনে উৎসবনির্ভর । দৈনন্দিন রুটিন নয় ।
—আরেকটা কথা বলি আপনাকে । একই মশারির ভেতর পাশাপাশি শুতে এখনও অস্বস্তি হয় আমার । কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় । আমি বলেছিলুম মায়াকে ।
—আমি তো ওভাবে শুই না । আমি তো আপনাকে অ্যাডাম মনে করি আর নিজেকে ইভ , তাহলে স্পর্শ বাঁচাব কেন ? বলেছিল মায়া , অকপটে ।
—আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি ? বলেছিলুম আমি ।
—এই নিন আপনার অস্বস্তি কাটিয়ে দিচ্ছি ; বলছেন ভালোবাসেন, ভালোবাসা তো সর্বগ্রাসী । বলতে-বলতে মায়া জড়িয়ে ধরল আমায় । বলল, এই কারণেই ঝর্ণার জলে গিয়ে স্নান করে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । জানি, শহরের সুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে গেছি, আদিম মানবীর গন্ধ হয়তো ছেয়ে গেছে দেহে । জানি না এখানকার স্বাভাবিক দেহ-গন্ধে আপনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পেরেছেন কিনা ।
—আপনার হাত যতক্ষণ না ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণ জড়িয়ে থাকুন প্লিজ, বললুম আমি । আমিও জড়িয়ে ধরব কিনা নির্ণয় নিতে না পেরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলুম । এখানে এসে তো কেবল লুঙ্গি পরে থাকি , যা কাচা হয়নি এখনও । মায়াও একই কাপড় পরে আছে ।
বহুক্ষণ ওভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল মায়া । অথচ আমার যৌনতার উদ্রেক হল না । আমিই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলুম এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে । বললুম, জানি, আপনার হাত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ; আমার অস্বস্তি কেটে গেছে । চলুন আমরা আমাদের আরামকেদারায় বসি । আরামকেদারা অর্থে কাঁঠালগাছের তলায় রাখা দুটো পাথর । গ্রামের লোকেরা ওদুটো আমাদের জন্যে এনে দেয়নি, ওগুলো আগেই ছিল ওখানে, হয়তো কাঁঠাল গাছে ওঠার জন্য কখনও এনেছিল কিশোর-যুবকেরা ।
পাথরের ওপর বসে মায়া শোনাত জীবনের সৌন্দর্যের গল্প । ও বলত, দেখছেন তো, জীবন মোটেই দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল , জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট , বর্বর নয় । শহরের সমস্তপ্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা ; তবু কত শান্তিতে রয়েছি ।
কাঠাল গাছে দাগ দেবার চার দিন পর আমরা ঝর্ণার জলে স্নান করতে গেলুম , অনেকটা হেঁটে, প্রায় তিন কিলোমিটার । আমাদের সঙ্গে তিনজন ছাত্র যোগ দিল । আমি ভালোভাবেই স্নান করলুম, গা থেকে নোংরা ঘষে-ঘষে তুললুম । চুলের জট ছাড়ালুম , আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে দাড়ির চুল ভালো করে ধুলুম । জলের আয়নায় নিজেকে প্রাগৈতিহাসিক মানব মনে হচ্ছিল । বহুদিন পর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছিল ।
মায়ার প্রায় পুরোটা সময় গেল ছাত্রদের দিকে নজর রাখতে । একজন ছাত্র, কার্তিকা, বলল, আজকে আকাশ এরকম মানে রাতে বৃষ্টি পড়বে, তখন বৃষ্টিতে নাচব ।
ছাত্রদের জল থেকে তুলে, তাদের নিয়ে আমি রওনা দিলুম আস্তানার দিকে, ছাত্রদের দুজনের চালা আমাদের চালা থেকে বেশ দূরে, আধঘন্টার বেশি হাঁটতে হবে ওদের । মায়াকে বললুম, আপনিও ভালোভাবে স্নান করে আসুন , আপনার চুল তো সাধুদের মতো হয়ে চলেছে , আমি এদের নিয়ে এগোচ্ছি । কিছুটা হাঁটার পর বালু মায়াগারু মায়াগারু বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, আম্মা আম্মা । দেখলুম মায়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে স্নান করছে । অপূর্ব লাগল । ভয়ও হল , প্রচণ্ড ভয়, যদি কেউ ওকে লুকিয়ে দেখতে থাকে ! তাকিয়েছিলুম ওর দিকে । তক্ষুনি মনে হল উচিত কাজ করছি না । এর আগে ওকে নগ্ন দেখিনি । দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে, আজও ।
মায়া ওদের আম্মা হয়ে উঠেছে কবে থেকে জানতুম না । বোধহয় কুয়োতলায় বাচ্চাদের আদর করার দৌলতে বা শিক্ষকতার কারণে ।
রাতে দুজনে দুজনকে নগ্ন পেলুম । একে আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে, প্রায়ান্ধকারে, মশারির বাইরে । মায়া প্রশ্ন করল, ইতস্তত করছেন ? নিজেকে ফর্নিকেটর বা আমাকে ফ্ল্যাপার ভেবে গুটিয়ে রাখছেন না তো নিজেকে , মিস্টার মায়ালিঙ্গা ।
বললুম, আপনি এখানে সবায়ের আম্মা হয়ে গেছেন , কিশোর-কিশোরীদের, তাদের মা-বাবার সকলের আম্মা ; আমি নিরঞ্জন দত্ত থেকে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে মিলিয়ে যাচ্ছি মায়ায়, নাম থেকে নামে , নামহীনতায় । কিন্তু আমার আর আপনার মাঝে আমি আর কাউকে চাই না, তাই ইতস্তত করছি । আমি চাই কেবল আপনি আর আমি , আমাদের নিজস্ব ব্রহ্মাণ্ডে ; আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা কোনো সংসার পাতাপাতি করব না । আমরা যদি যৌনকর্মে মিলিত হই তাহলে আমরা হয়তো একধাপ এগিয়ে যাব সংসার পাতার পথে। আমি আপনার অখণ্ড ভালোবাসা চাই । কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই না । আমি চাই না হঠাৎ কোনো শিশু এসে আমাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিক ।
মায়া বলেছিল, পিরিয়ডের প্রথম সাতদিন ও শেষ সাতদিন সেফ হয় । আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের তাপ অনুভব করুন আর তা স্মৃতিতে ধরে রাখুন । আপনি তো গণিত বিশেষজ্ঞ ; প্রকৃতি দেহের জন্যে গণিতের ছক তৈরি করে দিয়েছে । আমি আমার দেহের রসায়নের গণিত ও মিউকাস তৈরির কথা জানি , কী ভাবে তা ক্যালকুলেট করতে হয় জানি, কিন্তু নিজের দেহের তাপ তো নিজে অনুভব করতে পারব না । আপনি এই সময়ে প্রতিদিন আমাকে জড়িয়ে ধরবেন, যেদিন আমার শরীরের তাপ যৎসামান্য উনিশ-বিশ মনে হবে সেদিন জানাবেন । আমিও আপনার দেহের রসায়ন যাচাই করব । প্রকৃতি মনের তাপ আর দেহের তাপে পার্থক্য তৈরি করে রেখেছে । মনের তাপে আমরা কাছে আসব, আর দেহের তাপে যৌনক্রিয়া করব না । আমিও আপনার দেহের তাপ নজরে রাখব যাতে টের পাই যা আপনার দেহ অসুখের দিকে যাচ্ছে না । স্বাস্হ্য দেখে তো মনে হয় আপনার ইমিউন সিসটেম পর্যাপ্ত ।
জড়িয়ে ধরতে যাব, হাওয়ায় কেমন যেন বাঁশিতে তোলা উদারার আওয়াজ পেলুম , সম্ভবত ঝড়ের পূর্বাভাস , অদৃশ্য এক ধ্বনিকুহক ঝড়কে ডাকছে । সকালে কার্তিকা বলেছিল বৃষ্টি হবে, একজন বৃদ্ধও স্নান করতে যাবার পথে বলেছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, কেননা আজকে ঝড় উঠতে পারে । দুজনে বাইরে উঁকি দিলুম । দেখলুম আকাশ অমাবস্যার রাতের মতন অন্ধকার কিন্তু গোলাপি আভায় ছেয়ে গেছে । বালু ওর মায়ের হাত ধরে দৌড়ে-দৌড়ে এদিকে আসছে দেখে আমরা দ্রুত কাপড় পরে নিলুম । বালুর মা হাত নেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তুরপু তেলেগুতে যা বলল তা আমরা বুঝতে না পারলেও, এটুকু বুঝলুম যে আমাদের মতো ওরাও ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা করছে । বালুর কথায় স্পষ্ট হল যে এখানে থাকতে নিষেধ করছে ওর মা, ঝড় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ।
মায়া বলল, নিয়ে যাক না উড়িয়ে, হারিয়ে যাবার জন্যেই তো এসেছি ।
—পাগলামি করবেন না , এখনও সম্পূর্ণ ভালোবাসা পাইনি আপনার । মায়ার হাত ধরে টানতে-টানতে দৌড়োলুম বালুর মায়ের পেছনে, ঝর্ণার দিকে । প্রশ্ন করার সময় ছিল না । কিছুদূর গিয়ে মায়াকে কাঁধের ওপর তুলে নিলুম, কারণ ও খালি পায়ে দ্রুত দৌড়োতে পারছিল না । দৌড়োবার সময়ে দেখতে পেলুম, অন্ধকারে বহু ছায়া দৌড়োচ্ছে আমাদের সঙ্গে, পেছনে, সামনে, বাঁদিকে, ডানদিকে । কোথাব ছিল এত মানুষ, আগে তো এতজনকে একত্রে দেখিনি । ঝড় সবাইকে আতঙ্ক দিয়ে বেঁধে ফেলেছে । ঝর্ণার স্রোতকে পাশ কাটিয়ে সবাই উঠলুম পাহাড়ের ওপর । ছায়াদলের নেতা ঢুকে গেল পাহাড়ের কন্দরে । তাকে একে-একে অনুসরণ করল সবাই, আমরাও । অন্ধকার গুহা । কে কোথায় কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছিল না । কেবল চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল । মহিলারা স্বামীকে, ছেলেদের ডেকে একত্রিত করছেন হয়তো । ভেতরে ঢুকে, মায়াকে নামিয়ে, টের পেলুম আগে থাকতে অনেকে এসে বসে আছে । আমি মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রইলুম । বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে , শোনা যাচ্ছে মেঘের আনন্দ-চিৎকার , আর থেকে-থেকে ভেতরে ছিটকে আসছে তার চিৎকারের আলো । এই প্রথম দেখলুম আলোও প্রতিধ্বনিত হয় ।
সবাই গুহার উবড়ো-খাবড়া দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে রইলুম সারা রাত । মায়া আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ঘুমোইনি । জেগে বসেছিলুম সারারাত । ঘুমোলে যদি জেগে উঠে হঠাৎ নিজেকে দেখি দাদুর বাঙলোবাড়িতে আমার বিছানায় একা শুয়ে আছি ! অতীতকে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য । ভাবছিলুম সত্যিই কি পরিচিত প্রথিবীতে আছি না কি স্বপ্নের দুনিয়ায় ।
সকালে একে-একে বাইরে বেরিয়ে দেখলুম যে ঝড় বয়ে চলে গেছে অঞ্চলের ওপর দিয়ে । পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যদিকটায় দেখতে পাচ্ছিলুম অজস্র কলা আর পেঁপেগাছ ফলসুদ্ধ ভেঙে পড়ে আছে । এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছিলুম কাঁচা আর আধপাকা পেঁপে আর কলার কাঁদি কাৎ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিধারে । ক্ষুধার্ত ঝড় কলা আর পেঁপে খেতে-খেতে এসেছে , আমাদের ভয় দেখিয়ে, আরও ভেতরে ঢুকে গেছে ঝড়টা, ব্যারাইটের খনির দিকে । বোধহয় এটা ছিল বঙ্গোপসাগরে ওঠা এক সামুদ্রিক ঘূর্ণির ল্যাজের ঝাপটা ।
পাহায থেকে নামবার সময়ে চোখে পড়ল ঝর্ণার স্বাস্হ্যবতী হয়ে ওঠা কলকল নৃত্য । মায়া বলল, আমার হাত ধরে, আপনি ওভাবে হঠাৎ কাঁধে তুলে নিলেন আমায় ? ইন্সটিংক্টিভলি ? কাঁধে তুলে দৌড়োচ্ছিলেন যখন, আমি আপনার গলা জড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম আপনার হৃৎপিণ্ড কত দ্রুত কাজ করে চলেছে. আমারই জন্যে , কী আশ্চর্য , তাই না ?
বলেছিলুম, কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি তখন ; জাস্ট পৌঁছে যেতে চেয়েছিলুম পাহাড়ের ওপরে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ; আপনি যে আমার কাঁধে, আপনি যে আমার গলা জড়িয়ে ঝুলছেন, তা লক্ষ করার সম্বিত ছিল না তখন ।
যে যার চালার দিকে হাটতে লাগলুম । জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের এলাকায় পৌঁছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রায় সবায়ের চালা , সম্পূর্ণ পড়ে না গিয়ে থাকলেও , ভেঙেচুরে হেলে আছে । জঙ্গলের সুউচ্চ গাছগুলো চালাগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি । আমাদের চালাটা কোনোমতে টিকে আছে । তবে ক্লাস নেবার দেয়ালকে খেয়ে ফেলেছে ঝড়ে , আর বেরিয়ে পড়েছে দেয়ালের পাঁজরা, শুকনো পেঁপে গাছের ও অন্যান্য গাছের ডালপালা, যার ওপর মাটি-গোবর লেপে গড়ে উঠেছিল দেয়ালের আস্তরণ বা ব্ল্যাকবোর্ড ।
গোরুছাগল কোথায় থাকে আমি খোঁজ নিইনি কখনও ; মায়া জানে । পরে ও বলেছিল, জন্তুগুলোর জন্যে পাথরে ঘেরা দেয়াল আছে , সেখানে ঢুকিয়ে গাঁছের গুঁড়ির গেট বন্ধ করে দেয়া হয় রাতের বেলায় । ফলে ঝড়ে জন্তুগুলো ডাকাডাকি করলেও বহাল তবিয়তে আছে ।
আমাদের ঘরের ভেতরেও জল ঢুকে গিয়েছিল । মশারি ভিজে চুপচুপে । ক্যারিব্যাগ দুটো চলে গিয়েছিল চালার বাইরে, বেশ দূরে । খুঁজে আনতে হল । মায়া বলেছিল , দেখেছেন তো ? প্রকৃতিও আমাদের দুজনার সঙ্গে রয়েছে । আধুনিকতার বিষ থেকে আমাদের ধুয়ে দিয়ে গেল । আমাদের ঘর এবার আমরা নিজেরাই মাটি লেপে নতুন করে তুলব । মেঝেটাও মসৃণ করে নেব যাতে আপনার পিঠে না ফোটে ।
আমি মনে-মনে ভেবেছিলুম, আধুনিকতার বিষ কি এড়ানো যায় ? যায় না, তার কারণ আমাদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আধুনিকতা , মাদকের চেয়েও মহা আকর্ষক সেই নেশা । চলুন পালাই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে তো এসেছি, তা কি মুক্ত করেছে আমাদের , আমাকে ? সদাসর্বদা আধুনিক বস্তুর অভাব বোধ করতে থাকি । মায়া না থাকলে এখানে এক ঘন্টাও টিকতে পারব না । মায়াই আমার জীবনদায়ী ওষুধ ।
পুরো প্রিন্টআউট পড়া শেষ হলে ইন্সপেক্টর রিমা খান সংশ্লিষ্ট সিডিটায় লিখে রাখল ‘পঠিত’ । এবার খুঁজে বের করতে হবে মায়া পালকে । মায়া পালই কি প্রেমিককে খুন করে উধাও হয়ে গেছে । ইনি কি সত্যিই কেউ , নাকি বানানো গল্প । কোথায় থাকেন ? বোঝা যাচ্ছে বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে । উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙালি এলাকায় নিবাস, নিঃসন্দেহে । বাবার নাম জানা গেলে সুবিধা হতো । কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত একজন তরুণীর ওইভাবে জোতদার-জমিদার পরিবারের যুবককে প্রেমিক হিসাবে বেছে নেয়াটা কিরকম যেন বিসদৃশ ঠেকল ইন্সপেক্টর রিমা খানের । ইংরেজি ভাষার সঙ্গে গণিত কি মেলে ? মেট্রো রেলস্টেশান মানে এখানে দমদমই বুঝতে হবে, কেননা প্রেমিক মশায়ের সিদিগুলো পাওয়া গেছে ওনার বাড়িতে, যার সবচেয়ে কাছের মেট্রো রেলস্টেশান আপাতত দমদম । মায়া পালকে কিন্তু দমদমের মিলিউয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না । রাজারহাটের নিউটাউনও তখনও পর্যন্ত জমে ওঠেনি । মায়া পাল ওই স্টেশানে কি ওনার প্রেমিককে ধরার জন্যেই গিয়েছিলেন ? এই প্রেমের গল্পটাও তো অবিশ্বাস্য । কোনো ভালবাসাবাসি নেই, তার ব্যাকগ্রাউন্ড গড়ে ওঠেনি, ব্যাস, তরুণি বলল, চলুন পালাই, আর তরুণ তার সঙ্গে পালালো !
সিডিটায় , চিন্তা করছিল রিমা, ক্রিয়াপদের কালসঙ্গতি নেই ; কখনও লেখা হয়েছে অতীতকাল প্রয়োগ করে, আবার কখনও বর্তমানকাল । কংকালটা নিশ্চই বাংলায় ভালো মার্কস পেতো না । কিংবা হয়তো ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে লিখে গেছে ।
প্রিন্টআউটের মার্জিনে এই প্রশ্নগুলো, যেগুলো ওর মগজে উদয় হচ্ছে, লিখে রাখছে ইন্সপেক্টর রিমা খান ।
বাঁ আঙুলে ধরা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে নেভাল রিমা খান । ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল । টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । কঠিন প্রেম, জটিল প্রেমিক, রহস্যময়ী প্রেমিকা —নিজেকে নিঃশব্দে শুনিয়ে বলল রিমা । মনের ভেতরে ‘আধুনিকতার বিষ’ কথাটা ভাসতে দিল কিছিক্ষণ । আধুনিকতা কী, সেটাই তো জানি না । কোলকাতার কোন লোকটা আধুনিক ? কোন পাড়াটা আধুনিক ? আধুনিকতা ছাড়াই তো বিষে-বিষে ছয়লাপ । এককালে ছিল ঠগিরা । আর এখন ? ঠগ বাছতে ভারত উজাড় ।
দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ সেমিনারে গিয়েছিল রিমা , তাতে যোগ দিতে লন্ডন থেকে শার্লক হোমসও এসেছিলেন । উনি বলেছিলেন, তোমাদের দেশ থেকে স্বাধীনতার পর চারশো বিলিয়ান ডলার চলে গেছে সুইস ব্যাঙ্কে , আমার কাছে প্রতিটি লোকের নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর আর ডলারের অ্যামাউন্ট আছে ; আমি তালিকাটা দিতে চেয়েছিলুম , কিন্তু তোমাদের দেশের সরকার নিতে রাজি হল না । আসলে কেই বা রাজি হবে ? যার হাতে দেবো , তারই তো লুকোনো টাকার পাহাড় রয়েছে সেখানে ।
মডার্ন ইন্ডিয়া ! নিজেকে নিজে বলেছিল ইন্সপেক্টার রিমা খান ।
0 comments:
Post a Comment