ভূমিকাঃ এশিয়ার সর্ববৃহৎ গ্রাম
বানিয়া চং। ইতিহাস ও
ঐতিহ্যগত দিক থেকে গ্রামটি
সুপ্রাচীন। জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু
জ্ঞানীগুনীদের গৌরবোজ্জ্বল
ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে
স্বীকৃত। আজ থেকে প্রায়
বারো’শ বছর পূর্বে বানিয়াচং
রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
উল্লেখ্য, এককালে বানিয়াচং
ছিল তৎকালীন লাউড় রাজ্যের
রাজধানী। প্রাচীনকালে
বৃহত্তর সিলেট জেলা চারটি
রাজ্যে বিভক্ত ছিল। যেমন-
লাউড়, গৌড়, রাজপুর (তরপ) ও
জৈন্তা। তুলনামূলকভাবে লাউড়
রাজ্য ছিল জৈন্তা ও গৌড়
রাজ্য থেকে আয়তনে অনেক বড়।
সপ্তম শতাব্দীতে এই তিনটি
রাজ্য ছিল কামরূপরাজ গুহকের
শাসনাধীন। রাজা গুহকের মৃত্যুর
পর তিন পুত্র যথাক্রমে- গুড়ুক,
জয়ন্তক, লড্ডুক এর মধ্যে রাজ্য ভাগ
হয়ে যায়। লড্ডুক এর অংশে পরে
লাউড় রাজ্যের শাসনভার।
বর্তমানে বানিয়াচং যদিও
উপজেলা সদর তথাপি
বানিয়াচং এর মানুষজন এ-কে
গ্রাম বলে সম্বোধন করতেই
গর্ববোধ করেন। বানিয়াচং কে
কেউ বলে থাকেন পল্লীরাজ
কেউবা বলেন মহাগ্রাম।
ভৌগোলিক বিবরণঃ পল্লীরাজ
বা মহাগ্রাম বানিয়াচং
হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে
প্রায় আঠারো কিলোমিটার
উত্তর-পশ্চিমে এবং কিশোরগঞ্জ
সীমান্ত থেকে বার
কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
জনাব আতাউর রহমান তাঁর
বানিয়াচং থানা প্রসঙ্গে
লিখেছেন, হবিগঞ্জ শহর থেকে
বানিয়াচং ২৫ কিলোমিটার
দূরে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা
ভিত্তিহীন।
সীমানাঃ উত্তরে সুনামগঞ্জ
জেলার দিরাই, শাল্লা ও
হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ।
দক্ষিণে হবিগঞ্জ সদর ও দক্ষিণ-
পশ্চিমে লাখাই, পূর্বে হবিগঞ্জ
জেলার নবীগঞ্জ ও বাহুবল ও
পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলার
ইটনা ও মিটামইন উপজেলা।
বানিয়াচং গ্রামের দু পাশে
খাল,বিল, হাওড়ে পরিবেষ্টিত।
এখানে দো-আঁশ মাটি শতকরা
৭৫ ভাগ, বেলে মাটি শতকরা ১০
ভাগ, এঁটেল মাটি ও কঙ্কর শতকরা
১৫ ভাগ। বর্ষাকালে গ্রামটি
যেন বিশাল পানিরাশির
মাঝখানে সুউচ্চ সবুজ-শ্যামল
একটি ভাসমান সৌন্দর্যমন্ডিত
দ্বীপ ঢেউয়ের তালে
নাগরদোলায় দুলছে। অসংখ্য
পালতোলা নৌকা ছুটে
চলেছে আপনমনে আর সেইসাথে
এখনও ভেসে আসে
মাঝিমাল্লাদের ভাটিয়ালী
গানের সুর।
আয়তনঃ মহাগ্রাম বানিয়াচং
এর আয়তন বর্তমানে দৈর্ঘে প্রায়
৬.৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে
প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার।
গ্রামের চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত
(বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার
জন্য নির্মিত) গড়ের খাল নামে
পরিচিত একটি খাল এখনও যার
নিদর্শন রয়েছে। গ্রামের
চতুর্দিকে রয়েছে আবার সড়কপথ।
গ্রামের ভিতরে রয়েছে
শতাধিক কাঁচা-পাকা রাস্তা।
এই মহাগ্রামটিকে চারটি
ইউনিয়ন পরিষদ দ্বারা ভাগ করা
হয়েছে। যেমন- ১নং উত্তর-পূর্ব
ইউ.পি বানিয়াচং, ২নং উত্তর-
পশ্চিম ইউ.পি বানিয়াচং, ৩নং
দক্ষিন-পূর্ব ইউ.পি বানিয়াচং
এবং ৪নং দক্ষিণ-পশ্চিম ইউ.পি
বানিয়াচং।
জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারঃ
মহাগ্রাম বানিয়াচং এর
জনসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ সত্তর
হাজার। পল্লীরাজে শিক্ষার
হার প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ।
এখানে সনাতন ধর্মালম্বী
লোকদের মধ্যে ব্রাহ্মন থেকে
চন্ডাল পর্যন্ত সকল বর্ণ বা
গোত্রের লোক বসবাস করে
বিধায় এ-কে নবসোনার দেশ
বলা হয়ে থাকে। মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ এই গ্রামের শতকরা
৮২ ভাগ মুসলিম। এবং শতকরা ১৮
জন সনাতনী। ৬ থেকে ১০ বছরের
শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ১৮
শতাংশ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-
মন্দিরঃ এখানে ঊনিশটি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও
দশটি বেসরকারি রেজিষ্টার্ড
প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুইটি
সরকারি হাই স্কুল, বেসরকারি
হাই স্কুল চারটি,
কিন্ডারগার্টেন চারটি,
এবতাদায়ী মাদ্রাসা বারটি,
আলীম ও দাখিল মাদ্রাসা
তিনটি, তিনটি কলেজ, রামকৃষ্ণ
মিশন একটি, শতাধিক মসজিদ ও
অনেকগুলো মন্দির রয়েছে।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক
প্রতিষ্ঠানঃ সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা
প্রায় ২৭ টি। এর মধ্যে
উল্লেখযোগ্য নিবেদন
সাংস্কৃতিক পরিষদ, বাসনা
শিল্পী গোষ্ঠী, বানিয়াচং
থিয়েটার, জাগ্রত সংসদ,
অনির্বাণ যুব সংসদ, স্মরণীকা
স্মৃতি সংঘ, মিতালী সংঘ,
কিশোর সংঘ, শহীদ সায়ীদুল
হাসান পাঠাগার, আদর্শ
গণকেন্দ্র পাঠাগার,
বাহাউদ্দিন পাঠাগার,
উপজেলা সদর পাঠাগার, ব্র্যাক
গণকেন্দ্র পাঠাগার,
মোহাম্মদীয়া পাঠাগার
ইত্যাদি।
হাট-বাজারঃ বানিয়াচং
গ্রামে রয়েছে পাঁচটি
দৈনন্দিন বাজার। যথাক্রমে-
বড়বাজার, গ্যানিংগঞ্জ
বাজার, ৫/৬ নং বাজার, আদর্শ
বাজার, বাবুর বাজার।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বঃ
এককালে বানিয়াচং ছিল
রাজনীতির বিশাল পাদপীঠ।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও
দেশপ্রেমিকদের মাঝে যাঁদের
নাম উল্লেখ না করলেই নয়
তারা হলেন সর্বজনাব আবুল
হোসেন খান, খান সাহেব, নুরুল
হোসেন খান, এমপি এমএনএ, হেম
সেন, সুশীল সেন, সিরাজুল
হোসেন খাঁন (মন্ত্রী), গাজী
আব্দুল করিম খান, কাজী মাহতাব
খান, জনাব আলী এমপি, গোপাল
কৃষ্ণ মহারত্ন এমপি, শরীফ উদ্দিন
আহমেদ এমপি, মৌলভী
আব্দুল্লাহ, আব্দুল মালিক খান,
মাজুম উল্লাহ, আহসান উল্লাহ,
আব্দুস সালাম খান, আমির
হোসেন সহ শতাধিক
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
ঐতিহাসিক সাগর দিঘীঃ
ঐতিহাসিক সাগর দিঘী বা
কমলারাণীর দিঘীর নাম
শুনেননি এমন লোকের সংখ্যা
বাংলাদেশে খুব কমই আছেন। এর
আয়তন প্রায় ৬৫ একর, বানিয়াচং
রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা কেশব
মিশ্রের অধঃস্তন পুরুষ রাজা
পদ্মনাভ এই বিশাল দিঘী খনন
করান। প্রজাদের জলতেষ্টা
নিবারণের লক্ষ্যে এই দিঘী খনন
করা হয়। জনশ্রুতি আছে, দিঘী
খননের পর যখন ঐ দিঘীতে পানি
উঠেনি তখন রাজা পদ্মনাভের
কাছে দৈববাণী আসে
-‘পদ্মনাভ, তোমার ঐ দিঘীতে
জল উঠবে না, যে পর্যন্ত না রাজ
পরিবারের কোন সতীসাধ্বী এই
দিঘীতে আত্মত্যাগ করবে’। পরপর
তিনদিন স্বপ্ন দর্শনে ঐ বাণী
আসার পর ঘটনাটি তিনি রাণী
কমলাবটিকে খুলে বলেন। রাণী
সঙ্গে সঙ্গে নিজে আত্মত্যাগ
করার পূর্ণ বাসনা ব্যক্ত করেন
রাজার কাছে। রাণী ডুবে
যাওয়ার পর বেশ কিছুকাল পর্যন্ত
গভীর রাতে সোনার নৌকা,
সোনার বৈঠা হাতে তাকে
দিঘীর চারপাশে ঘুরে
বেড়াতে দেখা যেত বলে
জনশ্রুতি রয়েছে।
বানিয়াচং এর নামকরণঃ
বানিয়াচং এর নামকরণ নিয়ে
বিভিন্ন লেখকগণ বিভিন্ন
ভাবে তাঁদের লেখনীশৈলীর
মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন।
শ্রী অনাদিচরন বিশ্বাস তাঁর
বানিয়াচং কাহিনী গ্রন্থে
লিখেছেন, ‘ বিনায়ে জং
থেকে বানিয়াচং গ্রামের
উৎপত্তি’। ১২শ শতাব্দীর
প্রথমদিকে কনৌজ শহর থেকে
রাজা কেশব মিশ্র তাঁর সমস্ত
কিছু বিক্রি করে আত্মীয়-স্বজন,
সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পূর্ব
বাংলায় আসার জন্য রওয়ানা
হয়ে বংশিপ্যা নামক এক ক্ষুদ্র
পল্লীতে এসে উপস্থিত হন।
তথায় গোপীচাঁদ নামক এক হিন্দু
রাজা রাজত্ব করতেন। যখন কেশব
মিশ্র বং এর নিকট উপস্থিত হন।
তখন বং এর রাজা গোপীচাঁদ
তার সমস্ত সৈন্য নিয়ে কেশব
মিশ্রের আগমণে বাঁধা দেন।
উভয়ের মাঝে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে।
যুদ্ধে গোপীচাঁদ পরাস্থ ও নিহত
হন। কেশব মিশ্র কুলীন ব্রাহ্মন।
তিনি প্রথম যে স্থানে উপস্থিত
হয়েছিলেন সেই স্থানের নাম
বিনায়ে জং শব্দের
ক্রমবিবর্তনে বানিয়াচং রূপ
লাভ করেছে’। নামকরণের
আরেকটি ভিন্ন মত পরিলেক্ষিত
হয়। বানিয়াচং নামটি এসেছে
‘বানিয়া’ এবং ‘চাং’ এ দুটো
শব্দের ক্রমবিবর্তন থেকে। কথিত
আছে, ‘এখানে প্রাচীনকালে
পুটিয়া নামক এক বিরাট বিল
ছিল। বানিয়া নামের এক
শিকারী চাং(মাচাং) বেঁধে
ঐ স্থানে শিকার করত। ঐ
স্থানটি বানিয়ার চাং নামে
মশহুর হয়। পরবর্তীতে এটিই হয়
বানিয়াচং’। (ঐতিহাসিক
বানিয়াচং ও কিংবদন্তী,
পৃষ্ঠা-১১)।
জনশ্রুতি ও কিংবদন্তীতে আমরা
যা পাই তা হল- এককালে
বানিয়াচং গ্রাম অঞ্চলটি
পুটিয়া বিল নামক বিরাট
জলাশয়ে নিমগ্ন ছিল। কথিত
আছে যে, জনৈক ব্রাহ্মন বণিক
বাণিজ্য উপলক্ষে নৌকা
বোঝাই করে এতদঞ্চলে,
বাণিজ্য উপকরণ নিয়ে আসেন।
নৌকার মূল চালক ছিল একজন চঙ্গ
অর্থাৎ চন্ডাল বা নমঃশূদ্র/
চাড়াল। দৈবাদেশে তিনি
কালীপুজা শেষে একটি উঁচু
মাটির ঢিবির উপরে
কালীমুর্তি রেখে যান এবং
বণিক বা বানিয়া এবং চন্ডাল
বা ‘চঙ্গ’ নামের সমন্বয়ে এর
নামকরণ করা হয় বানিয়াচঙ্গ বা
বানিয়াচং। আবার কারো
কারো মতে, পূর্বোক্ত পুটিয়া
বিলে শিকারীগণ মাচাঙ্গ
বেঁধে পাখি শিকার করতো
এবং পাখিগুলো অন্যত্র
বিক্রয়ের ব্যবসা করতো, তাই
বানিয়া অর্থ ব্যবসায়ী এবং
শিকারীর চঙ্গ অর্থ চাঙ্গঁ বা
মাচাঙ্গঁ উভয় শব্দের সংমিশ্রনে
বানিয়াচং শব্দের উৎপত্তি।
মোঃ শাহজাহান বিশ্বাসের
‘বানিয়াচং এর ইতিবৃত্ত;
ইতিহাস ও কিংবদন্তী’ তে
সমালোচনা করেছেন এভাবে
যে-“ বানিয়াচঙ্গে বহু প্রাচীন
কাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের
অধিক প্রভাব ছিল এ কারণেই
সম্ভবত হিন্দু লেখকগণ তাঁদের
সম্প্রদায়ের সামগ্রিক প্রভাবকে
চিত্রিত করেছেন “.
পক্ষান্তরে, মোগল আমলে মুসলিম
সম্প্রদায়ের প্রভাবের কারণে ‘
বিনায়ে জং’ ফারসী শব্দের
অবতারণা করে বানিয়াচং
নামকরণ করে হিন্দু-মুসলিম
প্রতিযোগীতায় হার-জিতের
চিত্রই মুসলিম লেখকগণ চিত্রিত
করার প্রয়াস নিয়েছেন”।
কেশব মিশ্র কুলীন ব্রাহ্মন হয়ে
ফারসী শব্দ ব্যবহার করে
বানিয়াচং এর নামকরন করা
কতটা যুক্তিযুক্ত তা পাঠক ভাল
করে বুঝে নিবেন। পক্ষান্তরে,
বণিক বা বাণিয়ার নামের
সাথে চঙ্গ বা চন্ডাল/
চাড়ালের নাম সংযুক্ত করে
বানিয়াচং এর নামকরন করা
কতটা যুক্তিযুক্ত তাও প্রশ্নের
বাইরে নয়।
মূলকথা বানিয়াচং পল্লীরাজ
কিংবা মহাগ্রামের নামকরণের
প্রকৃত তথ্য এখনও উদঘাটিত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাঃ
স্বাধীনতাকামী
বানিয়াচংবাসী সর্বসময়ে
স্বাধীনভাবে বসবাস করার
প্রমাণ আমরা পেয়েছি মধ্যযুগীয়
শাসনামলে আনোয়ার খাঁ কর্তৃক
মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা
থেকে শুরু করে। ১৯৭১ সালে
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে
সারা বাংলার ন্যায়
বানিয়াচং বাসীও ঝাঁপিয়ে
পড়ে পাক-হায়নাদের বিরুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয়
সর্বাধিনায়ক এমএ রব ও এই
বানিয়াচং এর সন্তান।
স্বাধীনতা আন্দোলনে
বানিয়াচংবাসী যে
কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে তা
সর্বজন স্বীকৃত। বানিয়াচং এর
উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা
হলেন – আর.সি পান্ডে(দুলন),
নাজমুল হোসেন খান লুকু, আব্দুস
সালাম খান, সালেহ উদ্দীন
খান বুলবুল, জালালউদ্দিন খান
বাবুল, হায়দুরুজ্জামান খান ধন
মিয়া, আব্দুল আওয়াল চৌধুরী,
মোহাম্মদ আলী মুমিন, আমির
হোসেন, এম.এ খালিক প্রমূখ।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,খেলাধুলা
ও গুণি ব্যক্তিত্বঃ সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের দিক থেকে
বানিয়াচং সুপ্রাচীন কাল
থেকেই সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের
শাসনামলের বিখ্যাত কবি ও
বাউল শিল্পী মনসুর বয়াতী
বানিয়াচং পরগনার অধিবাসী
বলে জানা যায়। ড. দীনেশ চন্দ্র
সেন ময়মনসিংহ গীতিকা যে
অঞ্চলের লোকগাঁথা নিয়ে সমৃদ্ধ
করেছেন তার মধ্যে অধিকাংশ
লোক-সাহিত্যের অংশই তিনি
বানিয়াচং থেকে সংগ্রহ
করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
সুরত জামাল ও অধুয়া সুন্দরীর
প্রেমকাহিনী, রাণী ভবানীর
প্রেম কাহিনী, আলাল-
দুলালের কিচ্ছা, মদিনা সুন্দরীর
প্রেমকাহিনী এগুলো
বানিয়াচং এরই ইতিহাস ও
ঐতিহ্য।
লোক কবি ও সাধকঃ
বানিয়াচং গ্রামে যুগে যুগে
অনেক লোক কবি জন্মগ্রহন
করেছেন। এদেঁর মধ্যে মনসুর
বয়াতী, মকরন্দ রায়, নবনারায়ন
ভট্ট, এলাহী বক্স, মোহনলাল
(ডাঃ মনীন্দ্র চন্দ্র পাল), মহিবুর
রহমান, আখলাক হোসেন
খান,মোঃ শাহজাহান
বিশ্বাস, শামসুল হক কোরেশী,
কবি জয়তুন বিশ্বাস, মোঃ আবু
মোতালেব খান এর নাম
উল্লেখযোগ্য।
স্থাপত্য শিল্পঃ স্থাপত্য
শিল্পের মধ্যে বানিয়াচং এর
প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে
‘বিবিরমোকাম
মসজিদ’(সর্বপ্রাচীন),
‘কালিকাপাড়া মসজিদ’,(১৫৫৬
সালের শেষদিকে), ‘২ নং
হাবিলী মসজিদ’(অনুমান ১৬৮৫),
‘পুরানবাগ জামে মসজিদ’ (৯১৭
হিজরী সন), ‘চানপাড়া
মসজিদ’ (ব্রিটিশ পূর্ব ধারণা),
এছাড়াও এ গ্রামে শতবছরের
পুরানো মন্দির পরিলক্ষিত হয়।
খেলাধূলা ও খেলোয়াড়ঃ
এককালে বানিয়াচং ছিল
বৃহত্তর সিলেট তথা আসাম ও
বঙ্গদেশের খেলাধুলার এক
উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান।
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ
খেলোয়াড় বি রায় চৌধুরী
( ভূপেন্দ্র চৌধুরী, ১৯১৩-১৯৯২),
এসকে চৌধুরি(১৯১৫-১৯৭৮) এই
গ্রামের সন্তান। উল্লেখ্য বি
রায় চৌধুরী ছিলেন ঢাকা
একাদশের সেরা খেলোয়াড়,
মোহনবাগান স্পোর্টিং
ক্লাবের সাধারন সম্পাদক ও
উপমহাদেশের সেরা লেফট
আউট। আগরতলা স্পোর্টিং
ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক,
আসাম প্রদেশ স্পোর্টস
এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা
সম্পাদক, গৌহাটি মহারানা
স্পোর্টিং ক্লাবের
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
বানিয়াচং গ্রামের আরও
অনেক খেলোয়াড় ভারতবর্ষের
বিভিন্ন প্রদেশে গৌরবের
সাথে খেলাধূলা করে থাকেন।
এদেঁর মধ্যে কবির উদ্দিন খান,
সখায়েত হোসেন খান,
এডভোকেট সাহাব উদ্দিন
আহমেদ, বশারত আলী খান,
আলতাফ উদ্দিন চৌধুরী,
দিব্যেন্দু মহারত্ন রবি,
ভানুদেবের নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য।
স্পোর্টিং ক্লাবঃ
বানিয়াচং এর প্রাচীন
স্পোর্টিং ক্লাবদের মধ্যে এ
পর্যন্ত যেসকল স্পোর্টিং
ক্লাবের নাম উল্লেখযোগ্য
সেগুলি হল-
আমবাগান স্পোর্টিং ক্লাব
(১৯২৯), প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক
বশারত আলী খান,
নওজোয়ান স্পোর্টিং ক্লাব
(১৯৩৪), প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক
আব্দুল বারী খান,
গ্রীনগার্ডস স্পোর্টিং ক্লাব
(…..), প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক
কবি জয়তুন বিশ্বাস,
জুয়েল স্পোর্টিং ক্লাব(…..),
প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক তারাপদ
মহারত্ন,
ইলাভেন সোলজার্স(১৯৮৮),
প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক মোঃ
আবু মোতালেব খান,
সূর্যসেনা ক্রীড়া চক্র( ১৯৭৬),
প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক আমীর
হোসেন,
প্রগতি ক্রীড়া চক্র (১৯৭৪),
প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক মোঃ
আবু মোতাহেব খান।
এছাড়াও অনেক ক্রীড়া
সঙ্গঠনের অস্থিত্ব পাওয়া যায়।
শিক্ষাবিদ ও গুণীব্যক্তিত্বঃ
পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ,
পরিব্রাজক রামনাথ বিশ্বাস,
প্রফেসর মোঃ আলী, প্রফেসর ড.
সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ড. এমএ কুদ্দুস,
প্রফেসর জাহানারা খাতুন,
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে
হাসান আবেদ, বুদ্ধিজীবি
সায়ীদুল হাসান, ডাঃ মুশাহিদ
ঠাকুর, ডাঃ সাখাওয়াত
হোসেন জীবন সহ অনেক গুনীজন
এই গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বঃ
বাংলা গানের প্রখ্যাত
শিল্পী রাখি চক্রবর্তী,
বাংলাদেশের বিখ্যত আধুনিক
গানের শিল্পী সুবীর নন্দী,
মোঃ আবু মোতালেব খান,
তাপস মহারত্ন, দিব্যেন্দু
মহারত্নের নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যক্তিদের
পরিদর্শনঃ বানিয়াচং
মহাগ্রাম বহুযুগ পূর্ব থেকেই
সাহিত্য সংস্কৃতির একটি
উল্লেখযোগ্য স্থান। এখানে
পল্লী গানের সম্রাট আব্বাস
উদ্দিন আহমেদ ও পল্লী কবি
জসীম উদ্দিন সহ বহুগুনী
শিল্পীরা বিভিন্ন সময়
এসেছেন। ১৯৪৮ সালে আব্বাস
উদ্দীন ঐতিহাসিক এড়ালিয়া
মাঠে পরিবেশন করেন – ১. ও
বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল
বাইতে,
গরুর কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে
ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে…….
২. কোন রঙ্গে বাইন্ধাছ ঘরখানী
মিছা দুনিয়ার মাঝে
গো সাঁইজী কোন রঙে ইত্যদি
ইত্যদি।
( হবিগঞ্জ পরিক্রমা, পৃষ্ঠা- ৩৫৯,
লেখক- আতাউর রহমান)
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন
ঐতিহাসিক সাগর দিঘীর
পাড়ে বসে যে কবিতাটি
লিখেছে তার বর্ণনা করেন
সাবেক মন্ত্রী সিরাজুল
হোসেন খান এভাবে- “
জার্মানী, ইটালী অক্ষশক্তি
বিরোধী যুদ্ধ প্রচারনার জন্য
পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের
নেতৃত্বে কলকাতা থেকে এক দল
গায়ক আসলেন বানিয়াচং এ
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে।
আমাদের হাই স্কুলে পরপর দু’দিন
গানের আসর হল। দ্বিতীয় দিন
সকালে জসীম উদ্দিন সাহেব ও
আমি আমাদের বাড়ি থেকে
সাগর দিঘীর পশ্চিম পাড় দিয়ে
হাই স্কুলে যাচ্ছ। কতদূর যাওয়ার
পর দিঘীর পাড়ে একটি পুকুরের
কাছে দাঁড়িয়ে তিনি কি
জানি চিন্তা করতে লাগলেন।
কিছুক্ষন পর বললেন, একটা বসার
কিছু ও টেবিল পাওয়া যাবে ?
পাশের বাড়ি থেকে একটা
চেয়ার ও ছোট একটা টেবিল
আনিয়ে দিলাম। চেয়ারে বসে
টেবিলে কাগজ রেখে তিনি
একটি কবিতা লিখলেন সাগর
দিঘীর উপরে। সেই তাঁর
বিখ্যাত কবিতা – ‘কমলারাণীর
দিঘী’ – যাকে ভিত্তি করে
পরে একটি ছবি (ফিল্ম)
হয়েছিল”। (শতবার্ষিকী
স্মারকগ্রন্থ এল.আর উচ্চ বিদ্যালয়
বানিয়াচং, পৃষ্ঠা-৬৪)।
‘কমলারাণীর দিঘী’ কবিতার
প্রথম ও শেষ চরণগুলো –
প্রথমাংশ – “কমলারাণীর দিঘী
ছিল এইখানে,
ছোট ছোট ঢেউগুলি ছুটি তটের
পানে”।
শেষাংশ- “কোথায় ভট ব্রাহ্মন
কোথায় গণক দল,
জলদি করিয়া গুণে দেখ,
দিঘীতে কেন উঠে না জল”।
[ উল্লেখ্য, সনটা ১৯৪২ এবং
সিরাজুল হোসেন খান ঐ সনের
১৫ মার্চ হতে শুরুকৃত
মেট্রিকোলেশন পরীক্ষায়
অংশগ্রহনকারী ছাত্র। ]
শেষ কথাঃ বানিয়াচং
মহাগ্রাম বা পল্লীরাজ যা-ই
বলা হোক না কেন বর্তমানে
এটি উপজেলা সদর। এখানে
অনেক পীর-ফকির, অলী-
আওলিয়া সহ অনেক গুনী
মানুষের জন্মস্থান। বানিয়াচং
সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে
হলে অনেক সময়ের-তথ্যের
প্রয়োজন। বানিয়াচং কে
নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক
রূপকথা, এখানে রয়েছে
অনেকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা।
যেহেতু অতি সংক্ষিপ্ত
আকারে লিখা হয়েছে সেহেতু
অনেক কিছুই বাদ পড়া
স্বাভাবিক। সময়-সুযোগে
লেখার বাসনা পোষন করছি।
সেইসাথে এশিয়ার সর্ববৃহৎ গ্রাম
বানিয়াচং পরিদর্শনে
ভ্রমণকারীদের সাদরে আমন্ত্রন
জানাচ্ছি।
সংগ্রহেঃ মোঃ আবু
মোতালেব খান
ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উপদেষ্ঠা
সুত্রঃ হবিগঞ্জ ইনফো।
0 comments:
Post a Comment