জ্বর একটি সাধারণ উপসর্গ। বিভিন্ন রোগের
উপসর্গ হিসেবে জ্বর হয়ে থাকে। জ্বর হলে
শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার
চেয়ে বেড়ে যায়।শরীরের স্বাভাবিক
তাপমাত্রা হচ্ছে ৯৮•৬ ফারেনহাইট
(মুখগহ্বরে জিহ্বার নিচে) এই তাপমাত্রা
বেড়ে গেলেই আমরা তাকে জ্বর বলতে
পারি। আর দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানে
হল, দেহে পাইরোজেন (Pyrogens) উৎপন্ন
হয়েছে। এই জ্বর হলে করণীয় কী? এ
সম্পর্কে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা
রয়েছে। জ্বর হলেই অনেকে রোগীর
গায়ে কাঁথা চাপিয়ে দেন। তাদের ধারণা,
এতে করে রোগীর ঘাম দিয়ে জ্বর
ছাড়বে। জ্বর হলে ঠান্ডা হাওয়া আসার ভয়ে
ঘরের দরজা-জানালাও অনেকে বন্ধ করে
রাখেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোনটাই জ্বর
কমানোর পদ্ধতি নয় বা জ্বর কমাতে সাহায্য
করে না।
পাইরোজেন কি (Pyrogens) ?
পাইরোজেনকে বলা হয় Thermostavle
Bacterial Toxin, মানে তাপজীবাণুঘটিত বিষ।
এই বিষ শরীরের যেসব কলকব্জাগুলো
তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে তাদের
বিকল করে দেয়, আর অমনি আমাদের
পাইরেকশিয়া দেখা দেয়। রোগ নিরুপিত
হবার আগ পর্যন্ত জ্বরকে ডাক্তারী ভাষায়
বলা হয় Pyrexia বা পাইরেকশিয়া।
পাইরোজেনের প্রধান কাজ হল বাইরে
থেকে বড় যে আক্রমণ অন্য জীবাণুরা
করেছে, তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা
করা। পাইরোজেন যখন এই চেষ্টা করে
তখন শরীরের হরমোন, এনজাইম ও
রক্তকণিকাদের (মূলত শ্বেত কণিকা বা
থ্রম্বোসাইটদের) খুব দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে
যাতে করে বাইরের শত্রুদের ঠেকানো
সম্ভব হয়।
শত্রুরা আমাদের দেহে আক্রমণ করলে
আমাদের দেহ থেকে প্রচুর পাইরোজেন
নিসৃত হতে থাকে। পাইরোজেন আমাদের
দেহের সব জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে
জীবাণুদের মারতে শুরু করে। এখন দেহের
সব জায়গায় যদি পাইরোজেন গিয়ে গিয়ে
জীবাণুদের মেরে ফেলতে চায়, সে
কিভাবে সব জায়গায় যাবে?? যাবার পথ
একটাই হতে পারে, রক্ত। পাইরোজেন
রক্তের মাধ্যমে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
এই রক্তের মাধ্যমে কিছু কিছু পাইরোজেন
আবার পৌছে যায়, আমাদের মস্তিষ্কের
হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলে।
হাইপোথ্যালামাস পাইরোজেনের
সংস্পর্শে এলেই মস্তিষ্কের ভেতরের
দিকের আর একটা অঞ্চল, ভেসোমোটরে
সংকেত পাঠায় যে, দেহে শত্রুরা আক্রমণ
করেছে। ভেসোমোটর করে কি, দেহের
সব রোমকূপ দেয় বন্ধ করে, যেন আর বাড়তি
কোন জীবানূ ঢুকতে না পারে।
সেইসাথে আমাদের রক্তনালীগুলোকেও
সংকুচিত করে দেয়, যেন পাইরোজেন
সহজেই জীবাণুদের ধরে ধরে মারতে
পারে। রক্তনালী সংকুচিত হলে রক্ত
প্রবাহের গতি যায় বেড়ে, তাপ উৎপন্ন হয়।
সাথে আমাদের দেহে ক্রমাগত কিছু তাপ
তো উৎপন্ন হচ্ছেই।
রোমকূপ বন্ধ থাকার ফলে আমাদের
দেহের ভেতরে যে তাপ উৎপন্ন হচ্ছে,
তা আর বের হতে পারে না। আমাদের
দেহের তাপমাত্রা যায় বেড়ে।
জ্বর কেন হয় : জ্বর হওয়ার কারণ বিভিন্ন
ইনফেকশন, টিস্যু নেক্রোসিস ইত্যাদির
কারণে শরীরে জ্বর তৈরিকারী পদার্থ
পাইরোজেন নিঃসরণ হয়। এই পাইরোজেন
প্রোস্টাগ্লান্ডিন নামক কেমিক্যাল
মেডিয়েটর তৈরি করতে উত্তেজক
হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া
ব্যাকটেরিয়াল প্রডাক্ট, যেমন
ব্যাকটেরিয়াল কলাইপোপলিস্যাকারাইড
শ্বেতকণিকাকে উত্তেজিত করে ILI, TNF
(এন্ডোজেনাস পাইরোজেন) তৈরি
করে। এগুলো প্রোস্টাগ্লান্ডিন
তৈরিতে সাহায্য করে। এর ফলে
আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস
নামক অংশ বা আমাদের শরীরের
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার
রক্তনালি ও এর আশপাশের কোষগুলোতে
বেশি মাত্রায় প্রোস্টাগ্লান্ডিন তৈরি
করতে প্রভাবিত করে। এই সাইক্লিক এএমপি
হাইপোথ্যালামাস শরীরের তাপমাত্রা
স্বাভাবিক এর থেকে বেশি মাত্রায়
পুনর্নির্ধারণ করে, যার ফলে জ্বর তৈরি
হয়।
জ্বর কোন রোগ নয় :একটু জ্বর হলেই আমরা
ঘাবড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
একটি লোকও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া
যাবে না, যার কোনদিন একবারও জ্বর
হয়নি। জ্বর কিন্তু কোনও রোগ নয়। বহু
অসুখের একটি উপসর্গ।
এটা খুব গুরুত্বপুর্ণ যে, শুধু জ্বর বলে কিছু হয়
না। এটা যে কোন রোগের বাইরের
চেহারা। স্বর্দি-কাশি হলে জ্বর হতে
পারে, ম্যালেরিয়া হলেও হতে পারে।
আবার পড়ে গিয়ে হাত-পা কেটে
গেলেও হতে জ্বর হতে পারে। টাইফয়েড,
টি.বি সবার সাথেই জ্বর আছে!
কখন জ্বর বলা হয় : স্বাভাবিকভাবে
শরীরের তাপমাত্রা হচ্ছে ৩৬.৬-৩৭.২ সে.
পর্যন্ত। এর থেকে (১-৪ সে. পর্যন্ত) বেশি
হলেই আমরা ধরে নেই যে জ্বর হয়েছে।
এই জ্বর সেন্টিগ্রেড বা ফারেনহাইট
থার্মোমিটার দিয়ে মাপা হয়।
জ্বরের প্রকার : সাধারণত জ্বর তিন ধরনের
হয়ে থাকে-
# কন্টিনিউড (Continued) : জ্বর এর মাত্রা
যখন ২৪ ঘণ্টায় ১ সেন্টিগেড বা ১.৫
ফারেনহাইট তারতম্য হয়; কিন্তু জ্বর কোন
সময় স্বাভাবিক অবস্থায় আসে না, তখনই
তাকে কন্টিনিউড জ্বর বলে।
# রেমিটেন্ট (Remitent) : যখন জ্বরের
মাত্রা ২৪ ঘণ্টায় ২ সেলসিয়াস বা ৩
ফারেনহাইট তারতম্য হয়, তাকে
রেমিটেন্ট জ্বর বলে।
# ইন্টারমিটেন্ট (Intermitent) : যখন জ্বর
দৈনিক কয়েক ঘণ্টা শরীরে উপস্থিত
থাকে, তখন তাকে ইন্টারমিটেন্ট জ্বর
বলে।
এই ইন্টারমিটেন্ট জ্বর যদি প্রতিদিন আসে
তখন তাকে কোটিডিয়ান জ্বর বলে।
একদিন পরপর এলে টার্শিয়ান এবং দুই দিন
পরপর এলে কোয়ার্টান জ্বর বলে। তবে
এখন জ্বর নিরাময় ওষুধ এবং
অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ সেবনের
ফলে এই জ্বরের শ্রেণীবিন্যাস সব সময়
বোঝা যায় না।
কী কারণে জ্বর হয়ে থাকে
# যে কোনও একুইট ইনফেকশন বিশেষত পুঁজ
তৈরিকারক ইনফেকশন যেমন ফোঁড়া,
কার্বাংকল, ফুরাংকল। যেসব জীবাণু এর
সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলো হল
স্টাফাইলোকক্কাস অরিয়াস,
স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেন্স।
# যে কোনও ভাইরাসজনিত প্রদাহ যেমন
সর্দি জ্বর, কাশি, ডেঙ্গু, হুপিংকাশি।
# কলা বিনষ্টকারী বা টিস্যু নেক্রোসিস
যে রোগে হয়, যেমন মায়োকর্ডিয়াল
ইনফেকশন, আর্থাইটিস, রিউমাটিক ফিভার
বা বাতজ্বর।
# যে কোনও কোষ কলা অর্গানের
প্রদাহজনিত রোগ যেমন মেনিনজাইটিস,
একুইট অস্টিওমাইলাইটিস, একুইট
গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, একুইট
হেপাটাইটিস।
# অটোইমিউন রোগ যেমন এসএলই,
ইমুনোলজিক্যাল রিঅ্যাকশন।
# যে কোন টিস্যু বা অর্গান এর
ক্যান্সারের কারণে।
# দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বা ক্রনিক ইনফেকশন,
যেমন যক্ষ্মা রোগ।
# মহিলা ও পুরুষদের জননতন্ত্রের প্রদাহ।
যেমন প্রস্রাবে ইনফেকশন, প্রস্রাবের
নালিতে ইনফেকশন, মেয়েদের
অ্যান্ডোমেট্রাইটিস, সার্ভিসাইটিস,
উফুরাইটিস, সালফিনজাইটিস ছেলেদের
প্রস্টেটাইটিস, ইপিডিডাইমাইটিস,
অরকাইটিস।
# পরজীবী ঘটিত রোগ, যেমন
ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া,
ট্রিপোনোসোমা ইত্যাদি।
জ্বরের কারণ বের করার জন্য যে টেস্ট
করা হয়
# রক্তের সাধারণ টেস্ট টিসি, ডিসি
ইএসআর। এগুলোর মান স্বাভাবিক থেকে
বেশি হবে।
# একুইট পর্যায়ে প্রোটিনের পরিমাণ
স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
# এক্সরে চেস্ট।
# সিটি স্ক্যান/এমআরআই।
# রক্তের বিশেষ পরীক্ষা যেমন Widal,
Febrile antigen
# বডি ফ্লুয়িড পরীক্ষায় যেমন CSF ও
অন্যান্য বডিফ্লুয়িড।
# পরজীবী যেমন ফাইলেরিয়া,
ম্যালেরিয়া।
# দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন যক্ষ্মার জন্য
পিসিআর, এএফবি, কালচার
সেনসিটিভিটি।
# ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের জন্য এফএনএসি
সাইটোলজি, বায়োপসি, লিমফোমা ও
লিউকেমিয়া প্যানেল।
জ্বর প্রতিরোধের উপায়
# সম্পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম
# সমস্ত শরীর পানি দিয়ে মোছা, গোসল
করা।
# জ্বর কমার জন্য ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল
খাওয়া।
# জ্বরের কারণ বের করার জন্য বিশেষ
পরীক্ষাগুলো করা এবং সেই মতো
ডাক্তারের উপদেশ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
জ্বর হলে করোনিয়
জ্বর হলে এমনিতেই শরীরের তাপমাত্রা
বেড়ে যায়। তখন যদি আবার শরীরে
মোটা কাপড়, কম্বল জড়ানো হয় তবে
শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়।
ঠিক তেমনি জ্বর হলে গায়ে তেল মালিশ
করাও ঠিক নয়। এতে করে শরীরের
লোমকূপগুলো ময়লায় বন্ধ হয়ে যায় এবং
শরীরের বাড়তি তাপ বের হতে পারে
না। জ্বর হলে শরীরে মোটা কাপড়-চোপড়
জড়ানো উচিত নয়; কাপড়চোপড় যতটুকু
খোলা সম্ভব খুলে দিতে হবে। খোলা
রাখতে হবে ঘরের দরজা-জানালা। মোট
কথা, উন্মুক্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা
করতে হবে। সেই সঙ্গে ফ্যান থাকলে
সেটিও মধ্যগতিতে চালিয়ে দিতে হবে।
তারপর একটি তোয়ালে বা গামছা,
পরিষ্কার বা স্বাভাবিক পানিতে ডুবিয়ে
নিংড়ে নিয়ে তা দিয়ে সারা শরীর
আস্তে আস্তে মুছে দিতে হবে। এভাবে
বেশ কয়েকবার করলে তাপমাত্রা কমে
আসবে। ইচ্ছে করলে মাথাও পানি ঢালতে
পারেন। এরপরও জ্বর না কমলে ডাক্তারের
পরামর্শ নিন।
সুত্রঃ ইন্টারনেট।
0 comments:
Post a Comment